অনুমান করা যায়, ব্রডকাষ্টিংয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দৈনিক সংবাদপত্র মার খাবে। সংখ্যালঘুদের মতামত প্রকাশের জন্য কিছুসংখ্যক সাপ্তাহিক পত্রিকা হয়ত টিকে থাকতে পারে। কিন্তু পড়ার স্বভাব কমে গিয়ে, গ্রামোফোন শোনা বা অন্য কোন আবিষ্কার তার স্থলাভিষিক্ত হবে। একইভাবে ব্যবহার করে লেখার অভ্যাসকে সাধারণ জীবন থেকে বাদ দেয়া হবে।
যুদ্ধ বাদ দিয়ে পণ্যদ্রব্য যদি বৈজ্ঞানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে দৈনিক চার ঘন্টার শ্রম মানুষকে পরিপূর্ণ সুখ স্বাস্থ্যের মধ্যে রাখতে সক্ষম হবে। যে পরিমাণ কাজ করে কোন রকমে বেঁচে থাকবে তা তাদের মধ্যে একটা ভোলা প্রশ্ন বলে বিবেচিত হবে। সম্ভবত কেউ এটা কেউ ওটা পছন্দ করতে পারে। বিশ্রামের সময় নৃত্যে অংশ গ্রহণ, ফুটবল খেলা দেখে, সিনেমাতে গিয়ে মানুষ অধিকাংশ সময় ব্যয় করবে তাতে সন্দেহ নেই। সন্তানসন্ততি নিয়ে তাদের কাছে উৎকণ্ঠার কারণ নেই, রাষ্ট্র তাদের ভার নিয়েছে। বেশি রোগ ব্যারাম থাকবে না। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে বার্ধক্যকেও নতুন শক্তিতে সঞ্জীবিত করা যাবে। তখন তা ভোগবাদীদের স্বর্গে পরিণত হবে, যেখানে সকলের কাছে জীবন অসহনীয় হয়ে দাঁড়াবে।
এই যে দ্বিমূখী সমস্যা-তা কি এড়িয়ে যাওয়া যায়? অধিকতর বিষণ্ণ দিকটি জীবনের মধ্যে যা কিছু সর্বোৎকৃষ্ট তার জন্য প্রয়োজন কি? আমি তা মনে করি না। যদি মানুষের অবস্থার কোন পরিবর্তন না হয় তাহলে অজ্ঞ লোকেরা এখনও যা ভাবে, সত্যিকার ভাবে তা থাকলে অবস্থা নৈরাজ্যজনক রূপ নেবে। কিন্তু আমরা এখন মনোবিজ্ঞানী এবং শরীর বিজ্ঞানীদের দৌলতে জানতে পেরেছি যে মানব চরিত্রে যা আছে তার দশভাগের একভাগ হচ্ছে প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া এবং দশ ভাগের নয় ভাগ হচ্ছে উৎকর্ষ সাধন করার জিনিস। যাকে মানব প্রকৃতি বলা হয় শৈশবের শিক্ষার মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে তা একেবারে পরিবর্তন করে দেয়া যায় এবং পরিবর্তনগুলো হবে বিপদের আশঙ্কামুক্ত জীবনে পরিপূর্ণ সিরিয়াসনেস বলতে যা বোঝায় তা বজায় রাখা। এ উদ্দেশ্যের জন্য দুটো জিনিসের প্রয়োজন, কোমলমতি শিশুদের মধ্যে গঠনমূলক প্রবৃত্তির উন্নতি সাধন করা এবং যৌবন পর্যন্ত সেগুলো টিকিয়ে রাখার মত সুযোগ দান করা।
সে যাহোক আমরা সিরিয়াসনেস বলতে বুঝি প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণের কাজেই তা অধিকাংশভাবে নিয়োজিত। আমরা নিজেদের দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এবং আমাদের শিশুদের লাঞ্ছনার পাত্র হওয়ার বিরুদ্ধে এবং আমাদের দেশকে বিদেশী শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা করে থাকি। যাদের আমাদের দেশের শত্রু মনে করি তাদের আমরা মৌখিকভাবে এবং হাতে কলমে আক্রমণ করে থাকি। কিন্তু আবেগের অন্যন্য উৎসও রয়েছে সেগুলোও অত্যন্ত গতিশীল রূপ নিতে পারে। সৌন্দর্য সৃষ্টি অথবা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আবেগ এত বেশি হতে পারে, যে তা ভালোবাসার আবেগকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। ভালোবাসা যদি ধরে রাখার মত এবং নির্যাতন করার মত হয়, সৃজনশীল হতেও সক্ষম হবে। সৎশিক্ষা দেয়া হলে অধিকাংশ মানুষ গঠনমূলক কাজের মধ্যে আনন্দকে খুঁজে পাবে। কিন্তু শিক্ষা আসল শিক্ষা হওয়াই চাই।
তারপরে আমাদের দ্বিতীয় বিবেচনায় আসতে হয়। শুধু উচ্চতর কর্তৃপক্ষের হুকুম মেনে উপকারীর কাজ-সম্পাদন না করে তার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত গঠনমূলক একটা পরিবেশ অবশ্যই থাকতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক ও মৌলিক সৃষ্টির পথে অন্যান্য কোন বাধা থাকবে না। মানুষে মানুষে গঠনমূলক সম্বন্ধের মধ্যে এবং যে পথে মানুষের উন্নতি হতে পারে তার প্রতিকূল কোন প্রতিবন্ধক অবশ্যই থাকবে না। যদি সমগ্র অবস্থা তাই হয়ে থাকে এবং শিক্ষা ব্যবস্থা যথার্থ হয়ে থাকে, সিরিয়াস এবং উত্তেজনাপূর্ণ জীবন যাপন করার প্রচুর অবকাশ যারা অনুভব করে তারা অবশ্যই পাবেন। সেক্ষেত্রে এবং একমাত্র সে ক্ষেত্রেই যদি জীবনের শ্রেষ্ঠ দোষগুলোকে পরিহার করে সমাজ গঠন করা হয় তাহলে টিকে থাকবে, কেননা অধিকাংশ উৎসাহী সদস্যের কাছে তা সন্তোষজনক হবে।
আমি অবশ্যই স্বীকার করব যে, যে ভিত্তির উপর আমাদের সভ্যতা স্থাপিত তা বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। সেখানে অধিকসংখ্যক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এবং যেখানে অধিক সংখ্যক সংগঠন থাকবে সেখানে যতটুকু ক্ষতির আশঙ্কা করা যায় সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। কিন্তু তা একটি ক্ষতি করবে, যা হলো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার সুযোগ সুবিধাকে নষ্ট করে ফেলবে। বিশাল শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির মধ্যে একটা শক্তিহীনতার ভাব সৃষ্টি করবে, যার ফলে চেষ্টা শক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি শাসকেরা তার বাস্তবায়ন করে তাহলে অনেকগুলো বিপদকে এড়িয়ে যাওয়া যায় কিন্তু তার স্বরূপ হলো এমন যে বাস্তবায়ন করা অধিকাংশ শাসকের মধ্যে কিছুটা নৈরজ্যবাদ ঢুকিয়ে দেয়া উচিত যাতে করে নিষ্ক্রিয়তার কারণে ধ্বংস না হয় অথবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এত অতো বেশিও হবে না যার পরিমাণ। এটা এমন একটা জটিল সমস্যা যে থিয়োরিগতভাবে কখনো তা সমাধান করা তো যায়-ই না, কঠিন বাস্তবের মধ্যেও তার সমাধান পাওয়া যাবে না।