অনেক সাদা জাতির হাতে এখনো রাজনৈতিক গণতন্ত্র আছে বলে এগুলোকে উদভ্রান্ত চিন্তা মনে হতে পারে। সে যাহোক, আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, প্রত্যেক গণতান্ত্রিক দেশে স্কুলের শিক্ষার ততটুকু পর্যন্ত সুযোগ দেয়া হয়, যতটুকু শিক্ষা ধনীদের উপকারে আসে। কমিউনিস্ট হওয়ার অপরাধে স্কুল শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়, কিন্তু গোঁড়া হওয়ার অপরাধকে অপরাধ বলে ধরা হয় না। এটা যে অদূর ভবিষ্যতে পরিবর্তিত হবে আমি এমন কোন সম্ভাবনা দেখছি না। আমার চিন্তা হলো এই কারণে যে আমাদের সভ্যতা যদি ধনীদের স্বার্থে অনেকদিক ব্যবহৃত হয় তাহলে তা ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। কিন্তু আমি একজন সমাজতন্ত্রী, সে কারণে আমাদের সভ্যতা ধ্বংস হোক সেটা আমি চাই না।
আগের বক্তব্য যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে সৌভাগ্যবান কয়েকজন সংখ্যালঘু ছাড়া অন্যান্যের বেলায় পরিবার বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুতরাং সৌভাগ্যবান সংখ্যালঘু বলে কোন সম্প্রদায় না থাকলে পরিবার সম্পূর্ণভাবে লোপ পেয়ে যাবে। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে এটাকে অনিবার্য মনে হয়। পরিবার হচ্ছে এমন একটা প্রতিষ্ঠান অসহায় শিশুকে রক্ষা করাই হলো যার প্রধান কাজ। পিঁপড়ে এবং মৌমাছিদের বেলায় সমগ্র সমাজই সে দায়িত্ব বহন করে, তাদের কোন পরিবার নেই। সুতরাং মানুষের মধ্যেও যখন মা বাবার আশ্রয় ছাড়া, শৈশবকাল নিরাপদে কাটে তাহলে ক্রমান্বয়ে পারিবারিক জীবন লোপ পেয়ে যাবে। এই লোপ পাওয়ার ফলে মানুষেরর জীবনের আবেগের মধ্যে একটা পরিবর্তনের সূচনা হবে। পূর্ববর্তী যুগের সাহিত্য এবং শিল্পকলার সঙ্গে মানুষ সমস্ত প্রকারের আবেগের বন্ধন ছিন্ন করে ফেলবে। তার ফলে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে প্রভেদ কমে যাবে, যেহেতু সন্তানের বৈশিষ্ট্যগুলো সঞ্জীবিত করার এত কোন পিতামাতা থাকবে না। যৌন সম্পর্ক এবং ভালোবাসার আকর্ষণ এবং রোমাঞ্চ কমে যাবে, সম্ভবত সব প্রেমের কবিতা উদ্ভট বলে বিবেচিত হবে। মানব চরিত্রের রোমান্টিক উপাদনগুলো অন্যন্য পন্থা যেমন শিল্পকলা, বিজ্ঞান এবং রাজনীতির মধ্যেই উৎসারিত হবে। (ডিজরেলির কাছে রাজনীতি ছিল রোমান্টিক অভিযান) সে অনুসারে আবেগের যে ভাটা পড়বে তা অমি চিন্তা করতে পারি না। কিন্তু নিরাপত্তা সূচক প্রত্যেক কাজের মধ্যে ওরকম এক আধটু আবেগের ক্ষয় হয়ে থাকে। পালের জাহাজের মত স্টিমার এবং পর্বতের মানুষের মত ট্যাক্স উসুলকারী কখনো রোমান্টিক নয়। মনে হয়, শেষ পর্যন্ত। নিরাপত্তা ক্লান্তিকর হয়ে পড়বে এবং মানুষ বিতৃষ্ণার ফলে ধ্বংসশীল হয়ে উঠবে। কিন্তু এ সকল সম্ভাবনা হিসেব করে নিরূপণ করা সম্ভব।
আমাদের যুগের সংস্কৃতির প্রবাহ সম্ভবত শিল্পকলা থেকে আলাদা হয়ে বিজ্ঞানমূখী হয়ে পড়েছে তা অবশ্য বিজ্ঞানের সুপ্রচুর বাস্তব ব্যবহার্যতার কারণেই হয়েছে। রেনেসাঁর যুগের একটা বলবান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের যুগে চলে এসেছে। সামাজিক সম্মানই ছিল এর নির্ভরস্থল! একজন ভদ্রলোকের সামান্য পরিমাণ ল্যাটিন জানলেই চলে, বাষ্পীয় ইঞ্জিন কিভাবে তৈরি হয় জানার দরকার নেই। এই ঐতিহ্যের স্থায়ীত্বের পেছনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভদ্রলোকদেরকে সাধারণমানুষের তুলনায় কম কাজের মানুষ করে গড়ে তোলা। আমার ধারণা অত্যল্পকাল পরে যে লোক বিজ্ঞানের কিছুই জানবে না তাকে শিক্ষিত মানুষ বলে গণ্য করা হবে না।
এসব তো হলো সুফল, কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের সাংস্কৃতিকে বিভিন্ন দিকে মোড় ফিরিয়ে দিয়ে তার বদৌলতে আপন বিজয় কেড়ে নিচ্ছে তাই হলো সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার। শিল্পকলা ধীরে ধীরে অলসের কাজ এবং কতিপয় ধনী পৃষ্ঠপোষকের চিত্তবিনোদনের সেবাদাসী হয়ে উঠেছে। আগে যেমন ধর্মীয় এবং সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডে এর প্রয়োজন ছিল, এর প্রয়োজন সাধারণ মানুষের কাছে এখন আর তেমন অনুভূত হয় না। সেন্টপল নির্মাণে যে টাকা ব্যয় করা হয়েছে, সে টাকা যদি আমাদের নৌবাহিনীতে খরচ করা হতো তাহলে আমরা ওলন্দাজদের পরাজিত করতে পারতাম। তবে দ্বিতীয় চার্লসের সময় সেন্টপলের প্রয়োজনীয়তাই অধিক বিবেচিত হয়েছিল। আগে নন্দনতাত্বিক প্রশংসার মাধ্যমে মানুষের আবেগসঞ্জাত প্রয়োজনের পরিতৃপ্তি বিধান করা হতো, কিন্তু বর্তমানে অধিকভাবে তা তুচ্ছাতিতুচ্ছ যান্ত্রিক পদ্ধতিতেই প্রকাশিত হচ্ছে। গান এবং গানের সঙ্গে নৃত্য, সৌন্দর্যতত্বের নিয়মানুসারে একমাত্র রাশিয়ান ব্যালে নৃত্য ছাড়া এসবের কোনও শৈল্পিক মূল্য নেই। এগুলোকে কম আধুনিক সভ্যতা হতে আমদানি করা হয়েছে। শিল্পের অনিবার্য মৃত্যু দেখে আমার ভয় হয় যা আমাদের পিতামহের তুলনায় আমাদের অতিসাবধান সমূহবাদী জীবনের জন্য অতি আয়োজন। আমার ধারণা, আজ থেকে একশ বছর পরে একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি ভালো অঙ্ক জানবেন, জীববিজ্ঞানে তার জ্ঞান থাকবে এবং যন্ত্র কেমনে তৈরি হয় সে সম্বন্ধে অনেক বেশি জানবেন। অল্প কয়জন ছাড়া আর সকলের ক্ষেত্রে শিক্ষাকে গতিশীল করে তোলা হবে। তার মানে, মানুষ অনুভব অথবা চিন্তার জন্য নয়, শুধু কাজ করার জন্য শিখবে। তারা সব রকমের কাজ আশ্চর্য নিপূণতার সঙ্গে করতে পারবে, কিন্তু কাজটা করা উচিত কিনা যুক্তি দিয়ে তা চিন্তা করতে পারবে না। সম্ভবত চিন্তাবিদ এবং অনুভবকারী নামে দুটো সরকার স্বীকৃত শ্রেণীর উদ্ভব হবে। রয়েল একাডেমি বিবর্তিত হয়ে অনুভবকারী শ্রেণীর রূপ পরিগ্রহ করবে। চিন্তাবিদদের চিন্তার ফসলগুলো সরকারের সম্পত্তি, একমাত্র যুদ্ধ পরিষদে নৌবিভাগ, হাওয়াই তত্ত্ববিভাগের মন্ত্রীদের কাছেই তা ব্যক্ত করা হবে। কোন সময়ে শত্রুর দেশে রোগ ছড়াবার প্রয়োজন যদি পড়ে, তাহলে স্বাস্থ্যবিভাগকে এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। অনুভাবকেরা সিদ্ধান্ত করবেন স্কুলে থিয়েটারে এবং গির্জায় কি ধরণের অনুভূতিকে ছড়ানো হবে, যদিও সে আকাঙ্খিত আবেগটি কি আবিষ্কারের ভার থাকবে সরকারী চিন্তাবিদদের উপর। স্কুলের ছেলেরা না গ্রহণ করতে পারে ভেবে সম্ভবত সরকারি অনুভাবকেরা চিন্তাকে সরকারের গোপনীয় করে রাখা হবে। সে যাহোক বয়স্কদের সেন্সর বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ছবি দেখা এবং বক্তৃতা প্রচার করতে দেয়া হয়।