আধুনিক সভ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন কতকগুলো উপাদান রয়েছে যা পরিবারের বাধনকে দুর্বল করে ফেলেছে। শিশুদের প্রতি মানবিক অনুভূতি সহকারে শিশুকে যাচাই করাই হলো তার মধ্যে প্রধান। মানুষ উত্তরোত্তর অনুভব করছে যে সাহায্যকৃত না হলে তাদের পিতামাতার দুর্ভাগ্য অথবা পাপের জন্য শিশুদের কষ্ট ভোগ করা কিছুতেই উচিত নয়। বাইবেলে সবসময় সব অনাথ শিশুদের সম্বন্ধে দুঃখ করা হয়েছে এবং নিঃসন্দেহে তাদের অবস্থাও ছিল দুঃখজনক। সাম্প্রতিক কালে শিশুরা অন্যন্য যুগের শিশুদের চাইতে কম কষ্ট ভোগ করে। রাষ্ট্র এবং দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অবহেলিত শিশুদের পর্যাপ্ত স্নেহ সুযোগ দান করার বর্ধিত অনুরাগ বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলশ্রুতি স্বরূপ শিশুরা পিতামাতা এবং অন্যান্য অভিভাবকদের দ্বারা অতিরিক্তভাবে অবহেলিত হচ্ছে। জনগণের অর্থে অবহেলিত শিশুদের সেবা যত্নদান এবং প্রতিপালন করার পরিমাণ ধীরে ধীরে এমন ব্যাপক হয়ে দাঁড়াবে যে রাষ্ট্রের কাছে শিশুর দায়িত্ব অর্পণ করার সুযোগ পাওয়ার প্রবল আকাঙ্খবোধ করবে। আজকের দিনের স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন, যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা, বিশেষ স্তরের নীচে, শেষমেষ তারাই এ পদ্ধতির বাস্তবায়ন করবে।
এধরণের পরিবর্তনের ফলে খুবই সুদূর প্রসারী প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার হবে। পিতামাতার কর্তব্য বলতে যখন কিছুই থাকবে না, তখন বিবাহ ব্যবস্থারও প্রচলন থাকবে না এবং ক্রমশ যে সকল শ্রেণী রাষ্ট্রের দায়িত্বে সন্তান অর্পণ করতে পারবে তাদের মধ্যে বিবাহ ব্যবস্থা লোপ পেয়ে যাবে। সভ্য জগতে এ ব্যবস্থামতে খুব অল্প সন্তানই জন্ম গ্রহণ এবং প্রত্যেক জননীকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নাগরিকের জন্মদানের জন্য একটা নির্দিষ্ট ভাতা দান করবে। এ ব্যবস্থার সম্ভাবনা খুব স্বল্প নয়, বিংশ শতাব্দীর অবসানের আগেই ইংল্যাণ্ডে এ ব্যবস্থা চালু হতে পারে।
এগুলো যদি ধনতন্ত্রবাদী আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যবাদীদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সময়ে ঘটে তা হলে খুবই বিষময় ফল ফলতে পারে। তা বলতে গেলে, সর্বহারা যাদের পিতামাতা সন্তান কিছুই থাকবে না তারা এবং সঙ্গতি সম্পন্ন, যারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে তাদের মধ্যে দু’টি অংশে বিভক্ত হয়ে যাবে। সর্বহারারা রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষিত হয়ে তুর্কির’ ‘জানিসারীদের মতো, আবেগ প্রবণ সামরিক আনুগত্য পুষ্ট হয়ে গড়ে উঠবে। মেয়েদের এ শিক্ষা দেয়া হবে যে বেশি সন্তান ধারন করা তাদের কর্তব্য। সন্তান ধারণের জন্য রাষ্ট্রের বরাদ্দ টাকা জননীকে দেয়া ঠিক রেখে এবং অন্যদেশ লুণ্ঠণ এবং হত্যা করার সৈন্যের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হবে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু বলার মত বা শিক্ষা দেয়ার মত পিতামাতা যখন থাকবে না, তখন শিশুদের মনে বিদেশীদের প্রতি লোলুপতার অন্ত থাকবে না। ঐ মনোভাব তাদের মনে প্রবিষ্ট করিয়ে দেয়া হবে, যাতে করে বড় হলে প্রভুদের কথানুসারে অন্ধভাবে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করে তাকে শাস্তিদান করবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে দেশপ্রেম এবং মানবপ্রেম দুই ভাবধারা শিশুদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করিয়ে ধাপে ধাপে দু’শ্রেণীতে বিভক্ত একটি সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা খুবই সম্ভব। ওপরের স্তরে বিবাহ এবং পারিবারিক বাধ্যবাধকতা থাকবে এবং নীচের স্তরে শুধু রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য বোধ থাকবে। সামরিক কারণে সরকার অর্থের বিনিময়ে উচ্চহারে জন্ম সর্বহারাদের মধ্যে পাবে। স্বাস্থ্যবিজ্ঞান এবং ঔষদের কারণে মৃত্যুর হার হবে খুবই স্বল্প। সুতরাং জনসংখ্যাকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে অনসন ছাড়া রাখার জন্যে জাতিসমূহকে যুদ্ধে নামতে হবে। একমাত্র যুদ্ধ করেই অনসনের হাত থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। পরিস্থিতি এরকম হলে মধ্যযুগের হুন এবং মোঙ্গলদের আক্রমণের মত আমরাও একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রত্যাশা করতে পারি। এক জাতি বা কতিপয় জাতির ত্বরিত বিজয়ের মধ্যেই আমাদের একমাত্র আশা নিহিত।
রাষ্ট্র কর্তৃক শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এর যা ফল হবে তা হবে ওপরে যা বলা হয়েছে সোজাসুজি তার বিপরীত, যদিনা বিশ্বভিত্তিক একটা সংস্থা গঠিত হয় সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সংস্থা শিশুদেরকে বস্তুগত দেশপ্রেম শিক্ষা দিতে অনুমতি দেবে না এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক সামর্থ্যের বাইরে জনসংখ্যা বাড়াতে সুযোগ দেয়া হবে না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে প্রতিপালিত শিশুদের ওপর থেকে যদি সামরিক প্রয়োজনীয়তার চাপ সরিয়ে নেয়া হয়, আজকের গড়পড়তা শিশুর চাইতে শারীরিক এবং সামরিক দিকে সুস্থ হয়ে গড়ে উঠবে। সুতরাং পৃথিবীর দ্রুত প্রগতি সাধিত হবে।
যদি, একটি মাত্র কেন্দ্রীয় সংস্থা থাকে এবং বাকি রাষ্ট্র ধনতন্ত্রী অর্থনৈতিক পদ্ধতি থেকে সমাজতন্ত্রী পদ্ধতিতে অবতরণ করে, তাহলেও কিন্তু উল্টো ফল ফলবে। প্রথমোক্ত দুটোর যে কোনো একটাতেও শ্রেণী বিভাগ থাকবে যা আমরা একটু আগেই বলেছি। উচ্চ শ্রেণী পরিবারের মধ্যে অবস্থান করবে এবং নিম্নশ্রেণী রাষ্ট্রকেই পরিবারের বদলে গ্রহণ করবে। তার পরেও নিম্নশ্রেণীকে দুর্বল করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা উচ্চশ্রেণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করতে পারে। এর ফলে সাংস্কৃতিক একটা নিম্নমান প্রতিষ্ঠিত হবে, সে জন্যে সম্ভবত ধনীরা সাদা মানুষের চেয়ে কৃষ্ণকায় অথবা হলুদ বর্ণের সর্বহারা বংশবৃদ্ধিকে উৎসাহ দান করবে। শ্বেতকায় জাতিগুলো ধীরে ধীরে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজাত সম্পদায়ে বিভক্ত হয়ে নিগ্রোদের আক্রমণে একসময়ে সম্পূর্ণভাবে লোপ পেয়ে যেতে পারে।