.
০২.
মানুষের ব্যক্তিগত অথবা দলগত স্বপ্ন হাস্যাস্পদ হতে পারে, কিন্তু যারা সামগ্রিকভাবে মানবিকতার স্বপ্নে বিশ্বাসী তারাও মানবিকতার পরিমণ্ডলে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। জ্যোতির্বিদ্যার মাধ্যমে অন্তত ব্রহ্মাণ্ডের সম্বন্ধে আমাদের পরিচয় হয়েছে। টেলিস্কোপের মাধ্যমে যতটুকু দেখতে পারি তার বাইরে কি আছে কেউ বলতে পারে না। কিন্তু যেটুকু সম্বন্ধে আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি তা-ও অসীম অনন্ত। দৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ডের এক ভগ্নাংশ হলো ছায়াপথ, সৌরজগত হলো ছায়াপথের ক্ষুদ্রতর ভগ্নাংশ এবং এ সৌরজগতের ভগ্নাংশে আমাদের গ্রহটি হলো অনুবীক্ষণ। যন্ত্রের সাহায্যে প্রতীয়মান একটি কৃষ্ণকার বিন্দুমাত্র। এই ক্ষুদ্রবিন্দুতে একজাতীয় জলজ পদার্থের সঙ্গে পদার্থগত এবং রাসায়নিক গুণে সমৃদ্ধ অস্বাভাবিক গঠনের একজাতীয় কয়লার চাঙর নির্দিষ্ট কোন অবয়ব পরিগ্রহ করার আগ পর্যন্ত, কয়েক বছর ধরে নড়ে-চড়ে বেড়াত। তারা সময়কে বিভক্ত করে একদিকে নিজেরা অবয়ব রক্ষার এবং অপরদিকে সবকিছুকে তাদের মতো করে গড়ে তুলবার মানসে প্রচণ্ড সংগ্রাম পরিচালনা করতে থাকে। সাময়িক প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাদেরকে হাজারে হাজারে ধ্বংস করে ফেলল। রোগ অকালে অনেককে ছিনয়ে নিয়ে গেল। এগুলোকে দুর্ভাগ্য বলে গণ্য করা হতো। কিন্তু মানুষ যখন নিজের চেষ্টায় সমপরিমাণ ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হলো তখন তারা আনন্দিত হয়ে বিধাতাকে ধন্যবাদ দিল। সৌরজগতের বয়সের তুলনায় মানুষের যখন সশরীরে বসবাস সম্ভব হলো তা অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু এমন বিশ্বাস করারও অবকাশ রয়েছে যে বর্তমানের আগেও মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ববিবাদের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বাইরে থেকে দেখলে এভাবেই মনবজীবন সম্বন্ধে চিন্তা করা যায়।
আমাদের বলা হয়েছে যে জীবন সম্পর্কে এরকম দৃষ্টিভঙ্গি অসহনীয়, কেননা তার ফলে যে প্রবৃত্তির বলে মানুষ বেঁচে আছে, তারই ধ্বংসসাধন হবে। দর্শন এবং ধর্মের মধ্যে তারা এ প্রবৃত্তিকে এড়িয়ে যাবার পথ খুঁজতে চেষ্টা করেছেন। বাইরের পৃথিবীতে যথেষ্ট অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা থাকলেও তাদের কল্যাণে জানতে পেরেছি, পৃথিবীর মর্মমূলে একটা শৃঙ্খলাবোধ অবশ্যই আছে। আদি নিহারিকার যুগ থেকে প্রত্যেকটি দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের উন্নতি সাধিত হয়েছে একথা ধরে নেয়া হয়। ‘হ্যামলেট খুবই জনপ্রিয় নাটক, তাহলেও অল্পসংখ্যক পাঠকের মনেই প্রথম নাবিকের সংলাপ মনে থাকার কথা। যা মাত্র চারটি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধঃ আল্লাহ্ আপনার মঙ্গল করুন। কিন্তু ধরুন একটা সমাজ, যেখানে প্রত্যেক মানুষের জীবনের একমাত্র কর্তব্য হলো এই ভূমিকায় অভিনয় করা, হোরেসিও কিংবা হ্যামলেটের সঙ্গে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেখুন; তাহলে তারা কি বিশেষ ধরনের সাহিত্য সমালোচনা আবিষ্কার করবে না, যেখানে প্রথম নাবিকের চারটি শব্দই হবে নাটকের একমাত্র উপজীব্য বিষয়। তাদের সমাজে কোন লোক যে অন্যান্য অংশকেও সমান প্রয়োজনীয় মনে করে তাকে শাস্তি অথবা নির্বাসনদণ্ড কি দেবে না? হ্যামলেট নাটকে প্রথম নাবিকের উক্তি যেমন তেমনি ব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় মানুষের পরমায়ুও ততটুকু সংক্ষিপ্ত। আমরা নাটকের অন্যান্য দৃশ্য, চরিত্র এবং ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি না।
যখন আমরা মানুষের সম্পর্কে চিন্তা করি তখন প্রাথমিকভাবে নিজেদেরকে মানবজাতির প্রতিভূ হিসেবে ধরে নেই এবং তারপরে বিবেচনা করি যে তার নিরাপত্তার প্রয়োজন অপরিহার্য। ধরে নেয়া যাক, মি. জোনস হলেন এমন একজন মুদী দোকানদার, যিনি কোন গীর্জার শাসন মানেন না, কিন্তু তিনি তার অনন্ত জীবন সম্পর্কে একেবারে স্থির নিশ্চিত; তাই যে কেউ তার বিরোধিতা করলে তিনি তা মোটেই সহ্য করবেন না। কিন্তু তিনি যখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী এ্যাঙ্গলিকান গির্জার মি. রবিনসন, যিনি চিনিতে বালি মিশান, তার সম্পর্কে ভাবেন তখন তার অনুভূতিতে জেগে ওঠে যে ব্রহ্মাণ্ডের এখন সুবিচার পুরামাত্রায় বিরাজমান। তখন তার সুখের জন্য মি. রবিনকে আগুনে পোড়াবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এভাবে মানুষের মহাজাগতিক প্রয়োজনসমূহকে রক্ষা করা হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব এবং শত্রুতার মধ্যবর্তী প্রভেদগুলো দুর্বল এবং সার্বজনীন প্রীতির আবরণে ঢেকে রাখা যায় না। মি. রবিনসনও অংশতঃ বাদ দিয়ে মানুষের সুখ-সন্তুষ্টি মতবাদে বিশ্বাস করেন।
কোপার্নিকাসের পূর্ববর্তী সময়ে দর্শনে পৃথিবীর কেন্দ্রাভিমূখীতা রক্ষা করার কোন প্রয়োজন ছিল না। দৃশ্যমানভাবে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু পৃথিবী যখন কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে বিচ্যুত হলো মানুষও তার প্রাধান্য থেকে ছিটকে পড়ল। তাই বিজ্ঞানের স্থূলতা নিরসনের জন্য একধরনের মননশীল শক্তির প্রয়োজন দেখা দিল।
যারা এ মহৎ কর্তব্য করার গৌরব অর্জন করলেন, তাদেরকে বলা হয়ে থাকে আদর্শবাদী। বিশ্বে যা কিছু চোখে দেখা যায়, তাঁদের মতে সব কিছুই অলীক। পক্ষান্তরে, আমাকেই তারা একমাত্র সত্য হিসেবে ধরে নিলেন। এই আত্মিক শক্তিতে বলবানেরা সাধারণের উপর প্রভাব বিস্তার করলেন। গৃহের চেয়ে ভালো কোন স্থান খুঁজে না পেয়ে তারা শেখালেন সব জায়গা গৃহের মতো হেগেল পৃথিবীকে তার সমকালীন প্রাশ্যান সাম্রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন বেশি জোর দিয়ে। এসব মতবাদের স্বপক্ষে এত ফাপান-ফোলান যুক্তি প্রদান করা হয়েছে, স্বয়ং মতবাদ প্রণেতারা নিজেদেরকে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা থেকে বিযুক্ত করে রেখেছেন। তর্কের নীরস কচকচি থেকে উপসংহার হিসেবে এসব মতবাদের সৃষ্টি। ভুলভ্রান্তি দিয়েই আকাঙ্খর ঐকান্তিকতাকে যাচাই করা হয়। হিসাবের বেলায় একজন মানুষ তার স্বার্থের বিপক্ষের বদলে স্বপক্ষেই ভুলটা করে বেশি। যখন একজন মানুষ যুক্তির মাধ্যমে অগ্রসর হয়, তখন তার আশা-আকাঙ্ক্ষা যে দিকে নাগাল পায় না, সে দিকে অগ্রসর হওয়ার চেয়ে আকাক্ষার স্বপক্ষে ভুলত্রুটির মধ্যে জড়িয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক।