যদি ব্যাপকভাবে যুদ্ধ বন্ধ করা হয় তাহলে ঔষধ এবং স্বাস্থ্যতত্ত্বের সাহায্যে জনস্বাস্থ্যের প্রভূত উন্নতি সাধন করা যাবে। শান্তি এবং কল্যাণের প্রতিষ্ঠার জন্য সভ্যজাতিগুলোর মত অনুন্নত জাতিগুলোর পক্ষেও জনসংখ্যার বৃদ্ধি রোধ করা অবশ্যই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। বাস্তবে যারা জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে তারা হয়ত অঙ্ক জানেন না। অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে মানব সমাজে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কায়েম রাখতে চান। একজন মানুষ ধরে নিতে পারে যে কেন্দ্রীয় সংস্থা অনুন্নত জাতি এবং শ্রেণীর মধ্যে জনসংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেবে। কিন্তু বর্তমানে সরকার যেভাবে একমাত্র বুদ্ধিমানের মধ্যে ক্ষুদ্র পরিবার গঠনের জন্য উৎসাহিত করেন,তা সেরকম হবে না শেষমেষ, কাঁচামালের রেশন প্রবর্তন করার বিষয়টি বোধ হয় সর্বাধিক গুরুত্বসম্পন্ন। যুদ্ধের সঙ্গে কাঁচামালের খুবই ঘনিষ্ট সম্বন্ধ বর্তমান। তেল, কয়লা এবং লোহা যুদ্ধপূর্ব বিরোধের সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কাঁচামাল যে ন্যায়ত বন্টন করা হবে তা আমি বলছিনা, আমি বলছি সেগুলো এমন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে যাতে নিয়ন্ত্রণকারীর হাতে অপ্রতিরোধ্য শক্তি থাকে। আমি বিশ্বাস করি পৃথিবী একটি অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইউনিটে রূপ দেয়ার কাজ, সুবিচার সাফল্যজনকবাবে প্রতিষ্ঠা করার আগে সম্পাদন করা যাবে। আমি একজন আন্তর্জাতিক সমাজবাদী কিন্তু সমাজতন্ত্রবাদের চাইতে শীগগীর আন্ত র্জাতিকতাবাদের বাস্তবায়ন ঘটবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।
ধরে নিলাম পরবর্তী একশ পঞ্চাশ বছর সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সংস্থা সমস্ত যুদ্ধকে খুব তাড়াতাড়ি দমন করা সম্ভব ছোটখাট যুদ্ধে পরিণত করার মত শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত হয়ে উঠবে। তারপরে অর্থনৈতিক উন্নতি কিভাবে সংগঠিত হতে পারে জনসাধারণের কল্যাণ কি বৃদ্ধি পাবে? তারপরে কি প্রতিযোগিতা টিকে থাকবে? অথবা উৎপাদন ব্যবস্থা কি একচেটিয়া হয়ে যাবে? পরেরটা যদি হয়, তাহলে তা ব্যক্তি মালিকানাধীন, না রাষ্ট্র মালিকানাধীন একচেটিয়া উৎপাদন ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করবে? বর্তমানের চাইতে কম অবিচার শ্রমের উৎপাদন বন্টন কাজে তখন কি হবে?
এখানে দুটো বিপরীত প্রশ্নের উৎপত্তি হবে। প্রথমে হলো অর্থনৈতিক সংস্থা সম্বন্ধীয় আর দ্বিতীয়টা বন্টনের নীতি সম্পর্কিত। দ্বিতীয়টা নির্ভর করে রাজনৈতিক শক্তির ওপর। প্রত্যেক জাতি প্রত্যেক শ্রেণী সম্পদের অংশ সাধ্যমত করায়ত্ব করে থাকে। সাধারণত সশস্ত্র সৈন্যের রক্ষণাবেক্ষনের জন্য যে পরিমাণ সম্পদ প্রয়োজন সে প্রয়োজন অর্থের মালিকানা গ্রহণ করে থাকে। তা আপাতত বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক সংস্থার আঙ্গিক নিয়েই প্রথমে আলোচনা করা যাক।
ইতিহাসে অর্থনৈতিক সংস্থার কাঠামোতে কতক বেদনাদায়ক সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। যখনই অর্থনৈতিক সংস্থা সাধারণ লোকের স্বার্থে বৃহত্তর আকারে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল, তখনই তা (স্বল্পসংখ্যক অপাংক্তেয় প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে) সবলের ক্ষমতাধীনে আনয়ন করা হয়েছে। যেখানে একতার একমাত্র সম্ভাব্য পন্থা ছিল স্বেচ্ছাকৃত ফেডারেশন গঠন করা, সেখানেই একতার প্রতিষ্ঠা হয়নি। ম্যাসিডোনিয়ার বিরোধিতার মুখে প্রাচীন গ্রিসে ফরাসি এবং স্পেনের প্রতিকূলতায় ষোড়শ শতাব্দীর ইটালিতে একতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বর্তমানে আমেরিকা এশিয়ার বিরোধিতার মুখে ইউরোপেও কোন ঐক্য প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং আমি মনে করি শক্তি দিয়ে অথবা শক্তির ভয় দেখিয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থার সৃষ্টি করতে হবে। লীগ অব নেশন্সের মত স্বেচ্ছামূলক প্রতিষ্ঠান হবে না, কেননা এরকম প্রতিষ্ঠান বৃহত্তর শক্তিবর্গকে কখনো যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করতে বাধ্য করতে পারবে না। আমি আরো মনে করি, প্রাথমিকভাবে, কেন্দ্রীয় সংস্থাটি হবে অর্থনৈতিক এবং পরবর্তী স্তরে কাঁচামাল এবং ঋণ নিয়ন্ত্রণের উপর সমানভাবে নির্ভরশীল থাকবে। কতকগুলো রাষ্ট্রের সমর্থন এবং সাহায্য পুষ্ট কিছু পুঁজিপতি বেসরকারিভাবে এর প্রারম্ভিক সূচনা করতে পারেন বলে আমি মনে করি।
অর্থনৈতিক ভিত্তির দিক দিয়ে তা একচেটিয়া হবে। যেমন দৃষ্টান্তস্বরূপ পৃথিবীর যাবতীয় তেল সরবরাহ ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হলো। তার ফলে কেন্দ্রের সঙ্গে বিবাদকারী উড়োজাহাজ এবং তেলচালিত যুদ্ধযান অকেজো হয়ে পড়বে, যদি না তারা কোন তেলের খনি দখল না করতে পারে। একইভাবে সুস্পষ্ট পদ্ধতিতে অন্যান্য জিনিসের ওপর একই পদ্ধতি প্রবর্তন করা যায় ও বর্তমানেও পৃথিবীর প্রায় সমুদয় মাংস সরবরাহ শিকাগোর বৃহৎ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, আবার প্রতিষ্ঠানগুলোও কিছু অংশে জে. পি ম্যান এণ্ড কোম্পানির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। কাঁচামালকে উৎপাদিত পণ্যে পরিণত করার আগে অনেক ঘোর প্যাঁচ অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়, যে কোন অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তেলের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের স্বাভাবিক স্তর হলো একেবারে প্রথমেই নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা। অন্যথা, পোতাশ্রয়, জাহাজ এবং রেলপথ যেখানে একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেখানেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যাই কিছু কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করুক না কেনো, তার শক্তি যে কোন পক্ষের চাইতে বেশি। একস্তরে একচেটিয়া ব্যবস্থা উৎপাদনের কারণ মঞ্জুর করা হলে প্রাথমিক থেকে পরবর্তী স্তরগুলোতেও একচেটিয়া ব্যবস্থা কায়েম রাখার একটা সক্রিয় মনোভাব থাকবে। সংস্থার শক্তি বৃদ্ধির ফলে যে মনোভাব দেখা দিয়েছে তার ফলেই একচেটিয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উৎপত্তি হয়েছে রাজনৈতিকভাবে বৃহত্তর শক্তি এবং রাষ্ট্রের আয়তনের মধ্যে যার প্রকাশ ঘটেছে। সুতরাং আমরা বিশ্বাসের সঙ্গে গত অর্ধশতাব্দী যাবৎ যে প্রতিযোগিতা চলে আসছে তার ক্রম পরিসমাপ্তি কামনা করতে পারি। অবশ্য এটাও অনুমেয় যে ট্রেড ইউনিয়ন মজুরদের বেতন নিয়ে যে প্রতিযোগিতা ধীরে ধীরে তার অবসান ঘটাতে পারে। এ মতানুসারে, পুঁজিপতিরা যখন সংগঠিত হবেন তার বিপরীতে মজুরেরাও সংগঠিত হতে পারে, আইন করে বন্ধ করে দিলে দীর্ঘদিন এ মনোবৃত্তি টিকে থাকবে না।