এ দু বক্তব্য থেকে আমরা সুসংবদ্ধ সামাজিক সংগঠন এবং বৃহত্তর পৃথিবীর ঐক্যের সিদ্ধান্তে আসতে পারি। যদি আমাদের সভ্যতাকে উন্নতি লাভ করতে হয়, তাহলে কেন্দ্রে এমন একটা কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে যা সমস্ত পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। যদি বিরোধের কারণ বেড়ে না যায় তাহলে মানুষের যুদ্ধস্পৃহাও বেশি বলবৎ থাকবে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষটি সাধারণভাবে সরকারের মত হবে না এবং আমার মনে হয় তা হওয়াই বাঞ্চনীয়। তা আবার টাকার কারণে জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ লাগে বলে যারা বিশ্বাস করতে চান, তেমনি পুঁজিপতিদেরও একটি সংস্থা হবে না। আমেরিকার মত শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র এককভাবে, অথবা আমেরিকা এবং গ্রেটবৃটেন যৌথভাবে সে কেন্দ্র গঠন করবে না। এরকম কোনা অবস্থায় পৌঁছে যাবার আগে পৃথিবী রাশিয়া এবং আমেরিকার মধ্যে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। আমেরিকা পশ্চিম ইউরোপ এবং নিয়ন্ত্রিত ডোমিনিয়নগুলো আর রাশিয়া সমগ্র এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে, এ দুটো শিবিরই প্রতিরক্ষা কাজে শক্তিশালী এবং আক্রমণের বেলায় দুর্বল প্রমাণিত হবে। এভাবে তারা এক শতাদ্বী অথবা আরো বেশি কিছুকাল টিকে থাকতে পারে। সে যাহোক স্বাভাবিকভাবেই একবিংশ শতাব্দীতে কোন এক সময়ে যুদ্ধের ফলে সবকিছু তছনছ অথবা সমস্ত পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার এত একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা সংগঠিত হবে। আমি ধরে নিচ্ছি যে সভ্য জগত অথবা আমেরিকার পরিপূর্ণ বোধ থাকবে যাতে করে সম্ভাব্য বর্বর যুগের প্রলয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারে। তাই যদি হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে কী ক্ষমতা থাকা উচিত?
প্রথম এবং প্রধানত যুদ্ধ এবং শান্তির প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেয়ার মত সক্ষম তাকে অবশ্যই হতে হবে। অথবা এমন হতে হবে যুদ্ধের সময়ে এর সমর্থনধন্য পক্ষই দ্রুত জয়লাভ করতে পারবে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বলের ওপর নির্ভর করে এ লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। এর জন্য কোন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়ে না। বৈজ্ঞানিক যুদ্ধ ব্যয়বহুল যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। সে জন্য পৃথিবীর প্রভাবশালী পুঁজিপতিরা এক সঙ্গে মিলিত হয়ে ঋণ দিয়ে অথবা ঋণ বন্ধ করে দিয়ে যে কোন সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করতে পারে। ভার্সাই সন্ধির পরে যেমন জার্মানিকে চাপ দিয়ে নিরস্ত্র করে রাখবে। এভাবে তারা পৃথিবীর সমস্ত সৈন্যবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসবে। তাদের অন্যান্য করণীয় কাজের সঙ্গে এ মৌলিক দাবীটিও তাদের গ্রহণ করতে হবে।
সন্ধির স্বপক্ষে আলাপ আলোচনা চালানো এবং বিরোধ নিস্পত্তি করা ছাড়া আরো তিনটি বিষয় কেন্দ্রীয় সংস্থার অধীনে থাকবে। তাহলো (১) প্রত্যেক জাতীয় রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ করা (2) রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে জনসাধারণের চলাফেরা কিভাবে হওয়া উচিত (৩) এবং বিভিন্ন দাবীদারদের মধ্যে কাঁচামালের রেশন বন্টন করা। এর প্রত্যেকটা কিন্তু কয়েকটা শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
আঞ্চলিক আনুগত্যের ব্যাপারটি এখনও এমন উদ্ভটভাবে পালন করা হয় একারণে যে প্রাচীনকালের একজন সার্বভৌম রাজার প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য কালক্রমে আঞ্চলিক আনুগত্যে এসে রূপ নিয়েছে। কোন রাষ্ট্রের নাগরিক যখন তিনি যে জেলায় বাস করেন, সে জেলা অন্য রাষ্ট্রেরা অংশ বলে মতামত প্রদান করেন, তখন তাকে দেশদ্রোহী ভাবা হয় এবং কঠোর শাস্তিদান করা হয়। তারপরে তার মতামত অন্যান্য মতামতের এত রাজনৈতিক বিতণ্ডার কারণ হয়ে থাকে। ক্রয়ডেনের (Croyden) কোন লোক যখন বলেন যে ক্রয়ডেন লণ্ডনের অংশ হওয়া উচিত, তখন আমরা তার বিরুদ্ধে কোন বিরোধ অনুভব করিনা। কলম্বিয়া স্টেটের কোন গ্রামের নাগরিক যখন মনে করেন যে তার গ্রাম ভেনেজুয়েলার অন্তর্ভুক্ত হওয়াউচিত তখন তিনি তার সরকারের চোখে শাস্তির যোগ্য এক বিরাট দৈত্য বলে পরিগণিত হবেন। কেন্দ্রীয় সংস্থা জাতীয় সরকারকে এ রকমের কুসংস্কারপূর্ণ কিছু করার থেকে বিরত করবেন এবং আঞ্চলিক বিরোধের নিস্পত্তি যুক্তিগতভাবে, স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে পরামর্শ করে, তাদের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয় পর্যালোচনা করবেন।
বছর বছর জনসাধারণের একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার ফলে জটিল কঠিন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং মানুষের পক্ষে যেখানে কম মজুরি দেয়া হয়, সেখান থেকে বেশি মজুরি যেখানে পাওয়া যায় সেখানে চলে আসা খুবই স্বাভাবিক। এক রাষ্ট্রের মধ্যে এখন একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, কিন্তু বৃটিশ সাম্রাজ্যের মতো অনেকগুলো জাতি সম্মিলিত কনফেডারেশনে তা আজো স্বীকৃত হয়নি। এশিয়া থেকে আমেরিকা এবং স্বয়ংশাসিত ডোমিনিয়নের কোথাও গিয়ে বাস করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং ইউরোপিয়ানদের পক্ষেও আমেরিকায় গিয়ে বাস করার ব্যাপারে অনেক বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এর পক্ষে বিপক্ষে দু’দিকেই প্রবল যুক্তি রয়েছে। তারা এশিয়দের মধ্যে সামরিক মতবাদের জন্ম দিতে চায়। কালক্রমে তা সাদা জাতদের চ্যালেঞ্জ করার এত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ সাদা জাতিদের মধ্যে গত মহাযুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে।