আধুনিক বাণিজ্যপদ্ধতি যতই ব্যাপক এবং কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে বিপদও ততই বাড়ছে। জনপ্রিয় নয় এমন একটি মতামতকে যদি ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হয় তাহলে মহিলা ভোটাধিকার আন্দোলনকারীদের পন্থাই হবে একমাত্র পন্থা এবং তাতে যেখানে সরল আবেগবহুল সে অংশ প্রয়োগ করা উপযোগী জটিল এবং যুক্তিবহুল অংশ নয় সরকারি এবং বেসরকারি তদন্তের একমাত্র প্রতিক্রিয়া হলো যুক্তিযুক্ত কিছুর চাইতে আবেগবহুল কিছুর বিরোধিতা করা এবং শান্ত মস্তিষ্কে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এর সপক্ষে বিপক্ষের বিচার করে জনসাধারণের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া করবে স্পষ্টভাবে তা নির্ধারণ করা।
দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি সরকারি ডাক্তারি প্রকাশনার কথা ধরা যাক, যার কাজ হচ্ছে খারাপ প্যাটেন্ট ঔষুধের দোষগুণ তুলে ধরা, কিন্তু তা সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচারিত হবে না বলে কেউ জানবে না। অন্যদিকে খ্রিষ্টান বিজ্ঞানীরা মনে করে যে সব ঔষধই সমানভাবে বাজে এবং সে মত প্রচার করার ক্ষমতা তাদের আছে। একই ব্যাপার রাজনীতির ক্ষেত্রে সমানভাবে ঘটছে উভয়পক্ষই চূড়ান্ত মতামত প্রচার করতে পারে। অন্যদিকে সহনশীল এবং যুক্তিনিষ্ট মতামতসমূহ যেগুলো কর্তাব্যক্তিদের বিরোধিতা করে তাকে সেগুলো শোনার অনুপযুক্ত নীরস কচকচি বলে ধরে নেয়া হয়। অন্যান্য দেশের তুলনায় ইংল্যাণ্ডে যে বিপদ কম। কেননা ইংল্যাণ্ড প্রধানত বাণিজ্যভিত্তিক দেশ এবং বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাপ্রীতিকেও রক্ষা করেছে।
অবশ্য, কেউ যদি মনে করে যে যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তারা এর প্রয়োজনীয়তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে এর প্রতিবিধান উদ্ভাবন করা যায়। প্রমাণের গুরুত্ব যাচাই করে দেশপ্রেম এবং দেশপ্রেমের প্রতি পক্ষপাত শূন্য যুক্তি প্রয়োগ করতে পারে এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করা হলে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তা রোধ করা যাবে। সম্ভবতঃ এমন সময়ও আসতে পারে, যখন মানুষ বৃদ্ধিবৃত্তিকে মানবসমাজের উজ্জ্বল রত্ন বলে অনুভব করবে, কিন্তু আমি কোন আন্দোলনের মধ্যে সে অভিমুখে তেমন কোন লক্ষণ দেখছি এমন কথা বলতে পারবো না।
১৭. কতেক আনন্দময় অথবা ভিন্নরকম সম্ভাবনা প্রসঙ্গে
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কাল্পনিক এবং বৈজ্ঞানিক এ দু’ভাবেই লিখা যায়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্ভাব্য যা তা আবিষ্কারের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কাল্পনিক পদ্ধতিতে লেখকের মনে যা ভালো মনে হয় তুলে ধরেন। জোতির্বিদ্যার মতো একটি সুবিকশিত বিজ্ঞান কেউ কাল্পনিক পদ্ধতিতে গ্রহণ করবেন না। সূর্য অথবা চন্দ্রগ্রহণ ঘটলে কারো মনে আনন্দের সঞ্চার হবে এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করেন না। সামাজিক ব্যাপারে যারা সমাজের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে সাধারণ নিয়মনিষ্ঠ পদ্ধতিতে ভভিষ্যদ্বাণী করেন, তারা যতো বিজ্ঞাননিষ্ঠ বলে ভাণ করেন, আদতে তাদের মতামত অতোটা বিজ্ঞাননির্ভর নয়। ভবিষ্যতের মানব সমাজে কি ঘটতে যাচ্ছে, সে সম্বন্ধে কোন মতামত যে কোন প্রচেষ্টার মধ্যে প্রচুর অনুমান কল্পনা স্থান পায়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে কি ধরণের পরিবর্তন ঘটবে সে সম্বন্ধে আমরা আগাম কিছু বলতে পারি না। সম্ভবতঃ মানুষ বুধ অথবা মঙ্গল গ্রহে পাড়ি জমাতে পারে। সম্ভবতঃ আমাদের সকল খাদ্য শস্য উৎপাদিত না হয়ে রাসায়নিক গবেষণাগারে তৈরি হবে, দৃষ্টান্ত হিসেবে এগুলোকে তুলে ধরা যায়। এরকম সম্ভাবনার কোনো অন্ত নেই। আমি সে সবের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ না করে যে সকল মনোভাব বর্তমানে সস্পষ্ট হয়ে উঠেছে সে সম্বন্ধে আলোকপাত করতে চাই এবং সে সঙ্গে এটাও ভাবতে চাই আমাদের সভ্যতার গতি চলতে থাকবে, যদিও তাতে বিশেষ কোন নিশ্চয়তা নেই। যুদ্ধের ফলে আমাদের সভ্যতা ধ্বংস হতে পারে অথবা পরবর্তী রোমান সাম্রাজ্যের মতো তা বিলুপ্ত হতে পারে। কিন্তু আপদ বিপদ এড়িয়ে টিকে থাকতে পারলে তা কতেক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতে পারে সে সকল বৈশিষ্ট্য কী রকম হতে পারে আমি তা উদঘাটন করার চেষ্টা করছি।
যান্ত্রিক প্রবর্তনা এবং বিশেষতঃ তার প্রতিক্রিয়ার ফলে আরেকটা পরিবর্তন ঘটেছে। আগের তুলনায় সমাজ অধিকতর সুসংহত রূপ ধারণ করেছে। মুদ্রাযন্ত্র, রেলপথ, টেলিগ্রাম এবং বর্তমানে বেতার যোগাযোগ, আধুনিক রাষ্ট্র অথবা আন্ত র্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের যান্ত্রিক সুবিধা প্রদান করেছে। একজন ভারতীয় অথবা একজন চীনা কৃষকের জীবনে সরকারি কাজের কোন স্থান নেই। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের জেলাসমূহের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সরকারি কাজে ব্যাপক আগ্রহ পোষণ করে থাকে। সাম্প্রতিককালেই এ মনোবৃত্তির প্রসার হয়েছে। জেন অষ্টেনের লেখায় যে কেউ দেখতে পাবেন দেশের সঙ্গতিসম্পন্ন শিক্ষিত সম্প্রদায়ও নেপোলিয়নের যুদ্ধের কোন সংবাদ রাখতেন না। আধুনিককালের প্রধান প্রধান পরিবর্তন যে সামাজিক সংস্থার দ্রুত সংগঠনের কারণে হয়েছে আমি তাই তুলে ধরছি।
এর সঙ্গে বিজ্ঞানের আরেকটি ফলাফল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তাহলো বৃহত্তর পৃথিবীর ঐক্য। ষোড়শ শতাব্দীর আগে বলতে গেলে ইউরোপের সঙ্গে দূরপ্রাচ্য বা আমেরিকার কোনও সম্বন্ধ ছিল না। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর পরে সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ হতে ঘনিষ্টতর হতে থাকে। একই সময়ে রোমের অগাস্টাস এবং চীনের হ্যান সম্রাট নিজেদেরকে সমগ্র সভ্য দুনিয়ার একমাত্র প্রভু বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু আজকের যুগে এরকম আয়েসি কল্পনা করা অসম্ভব। পৃথিবীর প্রত্যেক অংশের সঙ্গে প্রত্যেক অংশের বাস্তব সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। তা শত্রুতার অথবা বন্ধুতার সম্বন্ধ যাই হোক না কোন উভয় ক্ষেত্রেই তা গুরুত্বপূর্ণ। শত বছর ধরে বিচ্ছিন্ন আরণ্যক থাকার পরে দালাইলামা একদিন দেখতে পেলেন যে রাশিয়া এবং বৃটিশ একত্রে তার সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের লুব্ধ মনোযোগে সংকুচিত হয়ে তিনি পিকিংয়ে চলে গেলেন। আমেরিকা থেকে সেখানেই তার পোষাক আশাক নিয়মিত আসতে থাকে।