এ সকল কারণে যে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে প্রচলিত শাসনব্যবস্থা খুবই সাফল্যজনক বলে বিবেচিত হয় অথবা যে দেশে আমেরিকান অর্থনীতির প্রভাব সর্বাধিক, ভবিষ্যতের যে কোন সময়ে কমিউনিষ্ট নীতি গ্রহণ করতে পারে তা আমি মনে করি না। পক্ষান্তরে শাসক সম্প্রদায় পূর্বাবস্থা কায়েম রাখার জন্য বর্ধিত হারে গোড়া হয়ে যাবে এবং সমাজের গোঁড়ামি কুসংস্কারকেই সমর্থন করবে। অবশ্য তাদের মধ্যে ধর্ম হলো সবচেয়ে প্রবল! জার্মানির নির্বাচনে গির্জা নিসংশয়ে ঘোষণা করল যে রাজকীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলে অখ্রিষ্টানসুলভ কাজ করা হবে। এসকল মতামত পুরস্কৃত হওয়ার দাবি রাখে এবং নিঃসন্দেহে পুরস্কৃতও হয়।
সুসংগঠিত ধর্ম, বিশেষ করে ক্যাথলিক ধর্ম ধনতান্ত্রিক দেশে বর্ধিতহারে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ধনীর স্বার্থে শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করাই তার কারণ বলে আমি মনে করি : রাশিয়া এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে যে বিভেদ, প্রধানতঃ অথনৈতিক পদ্ধতি সম্বন্ধীয় হলেও, বিশ্বাসের সকল স্তরে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়বে এ আশঙ্কা করা যায়। বিশ্বাস বলতে আমি বস্তু সম্পর্কে সে সকল কুসংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়ামির কথাই বলছি, যার সাহায্যে সত্যকে জানা যায় না। বিজ্ঞানের প্রতি অনুসন্ধিৎসা বোধ জাগিয়ে দিতে পারলে সমস্ত বিপত্তিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভবপর হয়ে উঠবে। বিশ্বাসের ওপর নয়, প্রমাণের ওপর নির্ভর করে স্বভাব গঠন করাকেই আমি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা বলতে চাই। যদিও শিল্পের জন্য বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলের প্রয়োজন, তবু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা সত্যিকারভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং কোন শাসকের প্রভাবমুক্ত বলে অধিকতর বাণিজ্যভিত্তিক। সুতরাং আমাদেরকে তা হল্যাণ্ড, ডেনমার্ক স্ক্যাণ্ডিনেভিয়া ইত্যাদি যে সকল দেশ আধুনিক জীবনপ্রবাহের বাইরে রয়েছে তাদের কাছ থেকে শিক্ষা করতে হবে।
আবার এটাও অসম্ভাব্য নয় যে এক শতাব্দী সময় বা তারও বেশি কিছু কাল সংগ্রামের ফলে তিরিশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধের পরে যেমনটি হয়েছিল, তেমনিভাবেই দু’পক্ষই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। যখন সে সময় আসবে তখনই উদার মতাবলম্বীরা তাদের মতামত প্রচারের সুযোগ পাবে।
আসন্ন বিরোধ বিসংবাদে কোন পক্ষে মনের একাগ্র আকাঙ্খায় যোগ দিতে অক্ষম বিধায় ইরাসমাস যেমন করেছিলেন, আমিও ঠিক তেমনি করব! আমি আমেরিকান ক্রোড়পতিদের তুলনায় বলশেভিকদের সঙ্গে অধিকতর একমত হতে পারব সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। শুধু তাদের দর্শন সত্য অথবা সুখময় একটি পৃথিবীর সৃষ্টি করতে সক্ষম একথা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আমি স্বীকার করি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ রেনেসার সময়ে জন্ম লাভ করে ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে ভয়ঙ্কর উ/রূপ পরিগ্রহ করেছে যদি শিল্পবাদী সমাজকে টিকে থাকতে হয় এবং যদি গড়পড়তা নরনারীর জীবনের সুখ-সন্তুষ্টি বিধান করতে হয় তাহলে অধিকতর সমবেত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। কিন্তু বলশেভিক মতবাদের প্রধান অসুবিধা হলো! সেখানে অমেরিকানদের মতো অর্থনীতি হলো সংস্থার চালিকা শক্তি। কিন্তু মানুষের প্রবৃত্তির পানে তাকিয়ে দল করা হলে তাতে সঙ্গতি আসে। পরিবার এবং রাষ্ট্রের সম্বন্ধ হলো জীববিজ্ঞানের আর ট্রাষ্ট এবং ট্রেড ইউনিয়নের সম্পর্ক হলো অর্থনীতির। জীববিজ্ঞানভিত্তিক দল গঠনের যে ক্ষতি, তা আজ আর কেউ অস্বীকার করেনা, কিন্তু যে প্রবৃত্তির ফলে এ দলগঠন হয় তা বিবেচনা না করে সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে আমি মনে করি না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমি তখন এই মেনে নেবো যখন সমস্ত শিশু পিতামতার হস্তক্ষেপ ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত হবে, অধিকাংশ মানুষ শ্রমসাধ্য কাজ করার উন্মাদনা হারিয়ে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে পড়লে বোধ হয়, জাতীয়তাবাদেরও নিজস্ স্থান রয়েছে, যদিও সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী স্পষ্টত তার প্রকাশ, কিন্তু তার উপযুক্ত ভূমিকা রাজনৈতিক যতটুকু নয়, তার চেয়ে সাংস্কৃতিক মানবশিশুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এবং শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করা যায়, যদি পরিবর্তনগুলো মৌলিক প্রবৃত্তিকে ধ্বংস করে ফেলে, তাহলে ফল দাঁড়াবে, মানুষ উদ্যম হারিয়ে ফেলবে। বলশেভিকরা অর্থনৈতিক পদ্ধতিকে একমাত্র মনস্তাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন আখ্যা দিয়ে বিরাট ভুল করেছে। পাশ্চাত্যের প্রতিযোগী সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অংশ গ্রহণ করে তারাও ভুল করছে, যদিও পাশ্চাত্যে এ ব্যাপারে কম সোচ্চার।
জীবনের অর্থনৈতিক দিকটির ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করাই হচ্ছে আমার মতে এ যুগের আসল ভ্রান্তি। শারীরিক প্রয়োজন তার জন্য প্রাচীন উদারনৈতিকদের সঙ্কেতবাক্য ছাড়া আর কিছু আমার জানা নেই, এবং আমি অনুভব করি যে তাও খুব বেশি কাজে আসবে না। মতামতের স্বাধীনতা এবং তার প্রসারই হলো এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। কিন্তু মতামতের প্রসার করাটা ভয়ঙ্কর প্রতিবন্ধকতা পরিপূর্ণ। কোন মতামতকে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হলে যে বিরাট প্রচারযন্ত্রের প্রয়োজন তার নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্র অথবা বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন। গণতন্ত্রের এবং শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তনের পূর্বে মতামতের ছিল সত্যনিষ্ঠা, সক্রিয় মতামত শুধুমাত্র স্বল্প সংখ্যক মানুষের জন্য সীমিত ছিল। আধুনিক ব্যয়বহুল প্রচার প্রোপাগাণ্ডা ছাড়া তাদের কাছে মতামত পৌঁছে দেয়া যেত। রাষ্ট্র এবং ধনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যে সকল বিষয় ক্ষতিকর এবং নৈতিকতার শত্রু মনে করে সে সকল বিষয়ের ব্যাপারে উদ্যম গ্রহণ করবে এবং টাকা খরচ করবে তা আশা করা যায় না কোন মতে। ধনতান্ত্রিক সংগঠনের মতো রাষ্ট্রও বাস্তবে হতাশা আমুদে বোকা বুড়ো মানুষের মত: কুসংস্কারের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, যুগের যা ভালো তার কিছু গ্রহণ করতে পারে না; কতকগুলো অক্ষম অকর্মণ্য ব্যক্তির অনুসন্ধান ব্যতিরেকে সক্রিয়ভাবে কোন মহত্বকে তুলে ধরা যায় না, যা অলিতে-গলিতে প্রচার করা যায় কিন্তু তার পাঠকও অলি-গলির মানুষ।