কৃষিভিত্তিক সমাজের চাইতে শিল্পভিত্তিক সমাজ অধিকতর দঢ়ভাবে সংগ্রন্থিত। কৃষিভিত্তিক সমাজে আইনতঃ ব্যক্তিকে যে শক্তি কোন প্রকারের বিপদের আশঙ্কা না করে অর্জন করা যায়। শিল্পভিত্তিক সমাজে ব্যক্তির হাতে অতটুকু ক্ষমতা প্রদান করা হলে মারাত্মক বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। অধিকন্তু তাতে হিংসা দ্বেষের অর্গল (অন্য অর্থে যাকে বিচারবোধ বলা যায়) খুলে যায়, যা সমাজতন্ত্রীদের অনুপ্রাণিত করে বিশেষভাবে। এসকল যুক্তি থাকা সত্ত্বেও আগামী শতাব্দীতে আমেরিকাতে যে সমাজতন্ত্র আসবে আমি তার কোন লক্ষণ দেখছি না। আবার আমেরিকা যদি মতামতের দিক দিয়ে সমাজতন্ত্রী না হয়, কোন জাতি তার অর্থনৈতিক পদ্ধতিতে সামান্য পরিমাণ সমাজতন্ত্রেরও প্রবর্তন করতে পারবে না। উদাহরণস্বরূপ জার্মানিতে ডাওয়েস পরিকল্পনা অনুসারে রেলওয়েকে রাষ্ট্রীয়করণের কথা বলা যেতে পারে।
আমার এ মনোভাব পোষণ করার পেছনে যুক্তি হলো, আমেরিকানরা বিশ্বাস করে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ম্লান হবেনা এবং সে কারণে আমেরিকাও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে না। যতদিন পর্যন্ত আমেরিকান শ্রমিকেরা সমাজতান্ত্রিক দেশের শ্রমিকদের থেকে ধনী থাকবে, ততদিন ধনতান্ত্রিক প্রচার অর্থনৈতিক ধ্বস ঠেকিয়ে রাখতে পারবে। এজন্য আমার পূর্বোক্ত বৃহৎ পণ্যোৎপাদনে অর্থনীতির প্রয়োজন সর্বাপেক্ষা অধিক। গোষ্ঠীর সংবাদপত্র, কোটিপতিদের দ্বারা পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা, গির্জাশাসিত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা, সুসংগঠিত পুস্তকব্যবসা যাতে পুঁজিপতিদের থেকে দান দিয়ে সস্তায় উৎপন্ন করে সীমিত গণ্ডীর বাইরে সস্তায় লক্ষাধিক বিলি করা যায়, রেডিয়ো এবং সর্বোপরি ছায়াছবি অতিরিক্ত করে সর্বত্র পয়সা রোজগার করতে পারে এত নির্মাণ করে পশ্চিমা জগতের সর্বত্র প্রদর্শন করা হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ এর সবকিছুতে নিয়ন্ত্রিত সংবাদ প্রচার এবং শক্তির অধিকারীদের মনোনীত দর্শন এবং বিশ্বাসকেই ব্যক্ত করা হয়।
এ জাতীয় প্রচারপ্রোপাগান্ডা যে সম্পূর্ণভাবে অপ্রতিরোধ্য তা আমি মনে করি না। সাধারণ মানুষকে যতদিন সাফল্যের কথা শুনাতে পারবে ততদিনই তা টিকে থাকতে পারবে। যুদ্ধে পরাজয় হলো ব্যর্থতার নিদর্শন তা সকলেরই জানা কথা। তার ফলে যে কোন শাসনব্যবস্থা উল্টে যেতে পারে। তবে আমেরিকার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা খুবই স্বল্প। সুতরাং উনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যাণ্ডে পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থায় সাফল্যজনক ছিল বলে জনগণ যে আগ্রহসহকারে পার্লামেন্টারি সরকারের দাবি করেছিল তেমনিভাবে আমেরিকার জন্য আমেরিকান পদ্ধতির প্রচার করতে পারে।
অবশ্য প্রাচী এবং প্রতীচ্যের অর্থনৈতিক নীতি ধর্মীয় কারণে বিভিন্নতার জন্যে প্রাচীন পদ্ধতিগত অর্থে জোরালোভাবে অবস্থান করবে। আমেরিকা খ্রিষ্টান এবং প্রাচ্যদেশ খ্রিষ্টানবিরোধী থাকবে তা সকলেই আশা করে। আরো আশা করতে পারে যে আমেরিকা খ্রিষ্টিয় নীতি অনুসারে বিয়ে এবং পরিবারের সপক্ষে শুধু মৌখিক সমর্থন দিতে থাকবে যখন প্রাচ্যের মানুষ সেগুলোকে বাসী কুসংস্কার মনে করবে। আশা করা যায় যে দু’পক্ষের মধ্যেই ব্যাপক নির্মমতা দেখা দেবে, এবং একের প্রোপাগাণ্ডা প্রচারের মধ্যে অন্যের নির্মমতা নির্দয়তাকে তুলে ধরা হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ খুব কম সংখ্যক আমেরিকান সাক্কো এবং ভেনজেট্টির সত্য কাহিনীটি জানে। অন্য মানুষ স্বীকারোক্তি করেছে এমন একটি খুনের জন্যে একটি মানুষকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। যে সংবাদের ওপর নির্ভর করে দণ্ড দেয়া হলো, কর্মরত পুলিশেরা ফ্রেমআপ যন্ত্রের সাহায্যে তা সংগ্রহ করেছিল। পরে যে লোকটি স্বীকার করেছিল যে সে খুন করেছে তার জন্য নতুন বিচারের ব্যবস্থা করতে অস্বীকার করা হলো, একারণে যে সে ছিল একজন বদ চরিত্রের লোক; সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে আমেরিকান বিচারকের মতামতে একমাত্র ভালো লোকরাই খুন করে। সাক্কো এবং ভেনজট্টির ওপর আসল অভিযোগ তারা ছিল নৈরাজ্যবাদী। ধনতান্ত্রিক বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঘৃণাবোধ জাগাবার জন্য সেসকল সংবাদ রাশিয়াতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। একইভাবে রাশিয়ান সমাজতান্ত্রিক কর্তৃক বিপ্লবী পিতৃতান্ত্রিকদের বিচারের কথা আমেরিকাতে জানা যায়। এভাবে অন্যকে জঘণ্যভাবে চিত্রিত করার জন্য প্রচুর প্রমাণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে কিন্তু আপন আপন ত্রুটির প্রতি কোনোও ভ্রূক্ষেপ করে না।
সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, তিনি মুনির নাম শোনেননি। মুনি ক্যালিফোর্নিয়া জেলে, নিজে করেননি এমন একটা খুনের অপরাধে অন্তরীণ ছিলেন। তা সত্ত্বেও রাশিয়ার কেরেনস্কির সময়ে প্রেসিডেন্ট উইলসন তদন্ত করবার জন্য একটা কমিটি নিয়োগ করলেন, তাদের মতে তাকে অপরাধী মনে করবার কোন সঙ্গত প্রমাণ নেই, কিন্তু সে একজন কমিউনিষ্ট।
মতামতের অত্যাচার সকল দেশেই এভাবে সহ্য করতে হয়। সুইজারল্যণ্ডে একজন কমিউনিষ্টকে হত্যা করা শুধু আইনসিদ্ধ নয়, যে লোক প্রথমে হত্যা করেছে, তাকে পরবর্তী হত্যার কাজে অভিজ্ঞ হত্যাকারী বলে নিয়োগ করা হয়। এ ব্যাপারে গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে জাপানের দৃষ্টান্ত সকলের উর্ধ্বে। একজন পুলিশ দু’জন নৈরাজ্যবাদী এবং তাদের ছোট ভাইপোকে পবিত্রজ্ঞানে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেছিল একটি থানায়। বিচারে তাকে নিদিষ্ট সময়ের জন্য কারাদণ্ড দান করা হয়েছিল। তারপরেও সে একজন বীর বলে চিহ্নিত হলো রাতারাতি এবং স্কুলের ছাত্রদেরকে তার প্রশংসায় রচনা লিখতে আহবান করা হয়েছিল।