এমন কোন সময় ছিলনা যখন মানুষের আকাঙ্খিত বস্তু মানুষের মধ্যে ন্যায্যতঃ বন্টন করে দেয়া হয়েছে। একটি স্থায়ী সমাজব্যবস্থার মধ্যে অবশ্যই এমন কতকগুলো পদ্ধতি থাকে, সে অনুসারে কম সৌভাগ্যবান মানুষেরা তাদের মন্দ ভাগ্যের জন্য অপরকে দোষারোপ করে এবং স্বভাবতঃই তা একধরনের বিশ্বাস বা সংস্কারবিশেষ। কিন্তু ব্যাপক স্বীকৃতি আদায় করতে হলে একটা বিশ্বাসকে সমগ্র সমাজ যে সকল অবিচারের নিন্দা করে তার ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করে থাকে। আমেরিকাতে তা যান্ত্রিক উন্নতি এবং জাগতিক আরামের ব্যবস্থা করেছে। হয়ত তা অনির্দিষ্টভাবে পরবর্তী স্তরের প্রয়োজনের সুব্যবস্থা করতে পারবেনা এবং নির্দিষ্ট সময় না আসা পর্যন্ত তা আগের এমতো চলতেই থাকবে। রাশিয়াতে শুধু ধনিকের স্বার্থে নয়, সর্বসাধারণের কল্যাণের জন্য শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনা করা হয়। রাশিয়ান মজুরেরা যে আমেরিকান মজুরদের চেয়ে দরিদ্র তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, কিন্তু এটা জেনে সে সান্তনা পায় যে (অন্ততঃ বিশ্বাস করে যে সে তার ন্যায্য অংশ পাচ্ছে এবং অন্য কাউকে অপ্রয়োজনে বড়ো এবং শক্তিমান করার জন্যে সে কাজ করছে না। অধিকন্তু যে নিজেকেও দৃঢ়সংবদ্ধ সামাজিক সংস্থার একটি একক বলে মনে করে, আলাদা আলাদা একক হিসেবে একে অন্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে বলে মনে করে না :
আমার মনে হয়, আমরা এখন রাশিয়ান এবং আমেরিকান বিশ্বাসের বিরুদ্ধবাদী আওতার মধ্যে এসে পড়েছি। আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গি শতাব্দীব্যাপী অপ্রতিহত প্রোটেষ্টান্ট মতবাদে কর্ষিত হয়ে গড়ে উঠেছে এবং ব্যক্তিগত সংগ্রামে কারো কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ না করেও দারিদ্র থেকে সমৃদ্ধির স্তরে উন্নীত হতে পারে। কল্পনায়, তাকে জংলি মানুষের মতো একজন ভাবা যেতে পারে, কিন্তু যদি বাস্তবে প্রতিযোগী মানুষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে তাহলে নির্ভর করার এত স্থায়ী কোন বিষয় নয়। মানসিক সংহতির বিনিময়ে বস্তু সম্পদ আহরণ করে মতামত প্রকাশের ব্যাপারে সারাজীবন দাস যে সংস্থা করে রাখে তাও ভালো নয়। যে সমস্ত মতামত সে অবশ্যই প্রকাশ করবেনা নিশ্চিতভাবেই সেগুলো আবাঞ্ছিত মতামত, বাধ্য হয়ে জিহ্বাকে শাসন করতে হয়। মাঝারি বয়সে পৌঁছুলে এ দৃষ্টিভঙ্গী সারাজীবন ধরে অবদমিত মতামতসম্পন্ন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে দাঁড়ায়।
পক্ষান্তরে রাশিয়া, বাইজান্টাইন গির্জা, তাতার এবং জারতন্ত্রে মানব মনের ওপর ধারাবাহিক চাপ প্রয়োগ করে ব্যক্তিজীবনের অনিত্যতাকে উদঘাটিত করেছে। আগে একজন ব্যক্তি যা ভগবানের উদ্দেশ্যে, গির্জার উদ্দেশ্যে এবং জারের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করত তা সমাজের জন্য কম কষ্ট সহকারে উৎসর্গ করা হয়। রাশিয়ান কমিউনিষ্টেরা তাদের পশ্চিমা হামদরদিদের সঙ্গে ব্যক্তির সম্মানের প্রশ্নে সম্পূর্ণভাবে ভিন্নরকম। এক্ষেত্রে তারা পূর্বসূরী বাইজান্টাইনদের তুলনায় অনেক বেশি খোলামেলা এবং তৎপর। তারা ওদের মত আত্মার অস্তিত্ব এবং অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস করে না। আত্মাকে অস্বীকার করে সোভিয়েট রাশিয়ার শাসকেরা হবস এর লেভিয়াথিনের সহধর্মী কোন মতকে একজন খ্রিস্টানের চেয়ে নিঃসন্দিগ্ধ চিত্তে গ্রহণ করতে পারে। তাদের মেনেনিয়াম এ্যাগরিপার উপকথায় বর্ণিত মানুষের বিক্ষিপ্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে একত্রে যদি যোগ করা যায়, তাদের কাছেও প্রতীচ্যের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ তেমনি মানব শরীরের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মত। শিল্পকলা, ধর্ম, নৈতিকতা পরিবার সবকিছু সম্বন্ধে তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিকভাবে এই ধারণা থেকে উদ্ভূত।
পশ্চিমের সমাজতন্ত্রীরা মাঝে মাঝে বলে থাকে যে তারাও একইভাবে সমাজের সর্বোচ্চ গুরুত্বে বিশ্বাস করে, কিন্তু বাস্তবে তা কদাচিৎ পরিদৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ একজন মানুষ দূরদেশে চলে যাওয়ার সময় স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে যেতে চাইবে এটা তাদের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। কিন্তু প্রাচ্যের একজন গোঁড়া কমিউনিষ্টের কাছে তা নিছক ভাববাদিতা ছাড়া আর কিছু নয়। তারা বলবে যে ছেলেপুলেদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে রাষ্ট্র এবং যেখানে যাচ্ছে সেখান থেকে পুরনো স্ত্রীর মত ভালো একটি স্ত্রী সহজে যোগাড় করা যায়। স্নেহ-মমতার স্বাভাবিক দাবিকে বিদঘুঁটে ব্যাপার বলে মনে করে। এটাও সত্য যে ধনতান্ত্রিক সমাজেও বাস্তবে এরকম ব্যাপার সহ্য করতে হয়, কিন্তু থিয়োরিগতভাবে তা অতোটা নয়। লেনিনের মতামত আমি যা বলেছি সম্পূর্ণভাবে তার বিপরীত। আমি মনে করি তাকে অসংগতি বলেই স্বীকার করে নিতে হবে, কারণ থিয়োরির আবরণ ছিন্ন করে একটা রক্তমাংসের মানুষের উদ্ভব হিসেবে লেনিন বেরিয়ে এসেছিলেন। একজন সত্যিকারের কমিউনিষ্ট লেনিনকে একজন ব্যক্তি না বলে একটি মুক্তির প্রতীক বলে অভিহিত করবেন বলে আমার ধারণা। ঈশ্বরবাক্যের মত কালক্রমে তিনি হয়ত বিমূর্ত রূপ ধারণ করবেন।
কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করে যে রাশিয়ানরা হঠাৎ অথবা ধীরে ধীরে প্রতীচ্যকে জয় করে ফেলবে। এ মনোভাবের সপক্ষে এমন কতেক যুক্তি রয়েছে আপাতঃদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পবাদের জন্য কমিউনিষ্ট দর্শন ধনতান্ত্রিক দর্শনের চেয়ে অধিকতর উপযোগী তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কারণ শিল্পবাদ অনিবার্যভাবে ব্যক্তির প্রতিকূলে বর্ধিতহারে সংগঠনের গুরুত্বকে বাড়িয়ে দেয়। জমি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা একজন ব্যক্তির চাইতে একটি শিল্পপদ্ধতির হাতে থাকাটা অধিকতর স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত। জমির ব্যক্তিগত মালিকানার দুটি উৎস। একটি হলো অভিজাততন্ত্রভিত্তিক, তলোয়ারের সাহায্যে মালিকানা অর্জন করা হয় যাতে, অন্যটি হলো গণতান্ত্রিক। সে মালিকানার ভিত্তি হলো কৃষক নিজের হাতে যে জমি চাষ করে তার মালিক সে নিজেই। একটি শিল্পভিত্তিক সমাজে এ দুটো পদ্ধতিই উদ্ভট এবং অকেজো বলে প্রমাণিত হয়েছে। খনির মাশুল এবং সামন্ত জমিদারী অভিজাততান্ত্রিক জমি মালিকানা উদ্ভটভাবেই স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়, যেহেতু জমিদার যে রাজস্ব পেয়ে থাকে তার কোন সামাজিক উপকারিতা নেই বলে দেখাবার ভান করে। আবার কৃষকের জমি চাষ করার যে অধিকার একইভাবে তাও জঘণ্য প্রমাণ করা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ দক্ষিণ আফ্রিকার একজন কৃষক জমি চাষ করার সময় সোনা পেলে এত সম্পদ অর্জন করতে সমর্থ হবে যে তাকে কোনক্রমেই সামাজিক কোন কর্মের ফলশ্রুতি বলা যাবে না। কোন মানুষের একটি ক্ষেত যদি শহরের উপকণ্ঠে পড়ে যায় তার সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। শুধুমাত্র ব্যক্তি মালিকানা নয়, জাতীয় মালিকানার মধ্যেও একই রকমের বিপত্তি দেখা দিতে পারে। মিশর এবং পানামা প্রজাতন্ত্র তাদের অঞ্চলের খালপথ নিয়ন্ত্রণ করায় তা এখন হাস্যাস্পদ হয়ে দাঁড়াবে এবং একই ভাবে অনুন্নত দেশসমূহে তাদের দেশের মাটিতে প্রাপ্ত তৈল ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণভার হাতে নিয়ে নিলে একই বিপদের উদ্ভব হতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে কাঁচামাল নিয়ন্ত্রণ করার যুক্তি থিয়োরিগতভাবে অপ্রতিরোধ্য এবং শুধুমাত্র কৃষি ঐতিহ্য আমাদেরকে এ সত্য স্বীকার করতে বাধ্য করায় যে ধনী প্রভাবশালী ব্যক্তিরা খনিজ দ্রব্য ব্যবহারের জন্য পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে অত্যাচার করে থাকে।