বৃটিশদের সবচেয়ে বিরাট ভুল হলো অনুন্নত জাতির সম্বন্ধে বিবেচনা করার সময় তার ঐতিহ্যের শক্তিতে অতিমাত্রায় বিশ্বাস স্থাপন করে। চীনদেশে এমন প্রচুর ইংরেজ আছেন, যারা চীনের প্রাচীন সাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞান রাখেন, জনসাধারণের কুসংস্কারের সঙ্গে সুপরিচিত; এমনকি রক্ষণশীল সাহিত্যিকদের মধ্যে তাদের বন্ধু বান্ধবও আছেন, কিন্তু নব্যচীন সম্পর্কে অবজ্ঞেয় নিস্পৃহতা পোষণ করা ছাড়া সত্যিকারভাবে বোঝে এমন একজনও ইংরেজ সেখানে নেই। জাপানিদের বিতাড়নের মুখে চীনের অতীতকে দিয়ে ভবিষ্যৎ বিচার করে এবং বলে যে শিগগির কোন পরিবর্তনের আশঙ্কা নেই। জাপানে, যেমন চীনদেশকেও পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি নতুন মর্যাদায় মণ্ডিত করেছে এবং ঘৃণার আসনেও বসিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ানদের বেলায় ঘৃণার প্রকাশ ঘটবে না; কেননা রাশিয়ানেরা পাশ্চাত্যের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবার জন্য চীনাদের সাহায্য করবে, দ্রুত পরিবর্তনের সাহায্যেই অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে সহজেই প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করানো যায়। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার পেছনে সরকারি সাহায্যের গৌরব রয়েছে বলে তরুণেরা বয়স্ক শিক্ষিতদেরকে সহজেই ঘৃণা করতে শেখে।
সুতরাং আগামী বিশ বছরের মধ্যে সমগ্র চীনদেশে কোনও উপায়েই বলশেভিক মতবাদকে প্রতিরোধ করা যাবে না এবং চীনারা রাশিয়ানদের সঙ্গে একটি ঘনিষ্ট রাজনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে। ধীরে ধীরে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যার মনে এ মতবাদটিকে প্রবিষ্ট করিয়ে দেয়া হবে। তারপরে আর অর্ধেক জনসাধারণের কি অবস্থা হবে।
প্রতীচ্য জগতের যেখানে সরকারের গোঁড়ামির এবং পূর্বাবস্থার কোনও পরিবর্তন নেই, বরঞ্চ সূক্ষ এবং সুপ্রচুর পদ্ধতিতে সেগুলোকে ধরে রাখা হয়েছে, আসলে প্রচলিত পদ্ধতির একটাও কোন প্রতিষ্ঠিত উদ্দেশ্য ছাড়া বেড়ে উঠতে পারেনি। আধুনিক বিশ্বাসকে খাঁটিভাবে ইউরোপে দেখা যায় না, মধ্য যুগের নানা বিশ্বাসের অপভ্রংশ ও আধুনিক বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে দেয়া যায়। একমাত্র আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রেই ধনতান্ত্রিক শিল্পবাদ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়েছে এবং সেখানে এর লক্ষণগুলো অত্যন্ত সুস্পষ্ট। পশ্চিম ইউরোপকে অবশ্যই পদে পদে আমেরিকান চরিত্রটি গ্রহণ করতে হবে, একারণে যে আমেরিকা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। একথার মানে আমি এ বলছিনা যে আমাদেরকে মৌলিকভাবে সে নীতি গ্রহেণ করতে হবে যা ছিল ধার্মিক কৃষকদের মধ্যে বপনকৃত ইউরোপিয়ানদের বিলম্বিত বিশ্বাস। আমেরিকার কৃষিপ্রধান অংশ, আন্তর্জাতিক দিক দিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং মহৎ বিশ্বাস। কিন্তু এই বিশ্বাসটি আমেরিকাতে একরকম রাশিয়াতে আরেক রকম। এই দুই প্রতিষ্ঠানের বৈপরিত্যই পৃথিবীর সুখ শান্তির সঙ্গে জড়িত।
রাশিয়ার মত আমেরিকারও একটি আদর্শ আছে, তার বাস্তব রূপায়ণ এখনো হয়নি। শুধু থিয়োরিগতভাবে সে আদর্শের সঙ্গে মূল্যবোধের সংযোজন করা হয়েছে। কমিউনিজম হলো রাশিয়ার আদর্শ আর আমেরিকার আদর্শ হলো স্বাধীন প্রতিযোগিতা। যে অর্থনৈতিক পদ্ধতি রাশিয়ান আদর্শের চূড়ান্ত প্রতিবন্ধক সে পদ্ধতিই হচ্ছে আমেরিকান আদর্শের পরম সহায়। কমিউনিস্টরা যেখানে সংগঠনের ভিত্তিতে চিন্তা করে, সেখানে আমেরিকানরা ব্যক্তির পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করে। রাজনীতিতে যারা তরুণ তাদের সামনে লগ কেবিন থেকে হোয়াইট হাউজ’ নীতিকে তুলে ধরা হয়, ব্যবসার ক্ষেত্রে উন্নতি করার জন্য অনুরূপ একটি অর্থনৈতিক পদ্ধতিরও জোড়ালো বিজ্ঞাপন দান করা হয়। এটা সত্য কথা যে, সকলের পক্ষে হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করা অথবা কোন কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তা পদ্ধতির দোষ নয়। প্রত্যেক যুবকের কাছে আবেদন করে সঙ্গীদের চেয়ে অধিকতর পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিমান করে তোলবার জন্য তা করা হয়। আমেরিকাতে তখন এত সুযোগ ছিল যে অধিকাংশ লোকের পক্ষে অন্যের ঘাড়ের ওপর পা না রেখে কিছু পরিমাণ সাফল্য অর্জন করতে পারা যেত। এখনও মানুষ সেখানে শুধু জাগতিক উন্নতির প্রত্যাশা করে এবং শক্তির পরোয়া করে না। আমেরিকার একজন মজুর মহাদেশের অন্যান্য মানুষের চাইতে বেশি আয়ও করতে পারে।। কিন্তু ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আসছে। যারা সুযোগ সুবিধা থেকে বাদ পড়েছে: দাবি দাওয়া নিয়ে আসবে অন্তত তাদের কাছ থেকে একটা বিপত্তি প্রত্যাশা করা যেতে পারে। নেপোলিয়নের প্রতিভাবানেরা অনেক কিছু করতে পারে এ বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করে বাদবাকি কাজ সমষ্টিগত প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে ব্যক্তিক চেষ্টায় সাফল্যমণ্ডিত করতে পারে বলে মনে করে। কমিউনিজম দর্শনে গ্রুপ অথবা দলই হলো সাফল্যের মূল কারণ, কিন্তু আমেরিকান দর্শন অনুসারে ব্যক্তি প্রাধান্য লাভ করে। ফলতঃ যে লোক কোন কাজে সফলতা অর্জন করতে অকৃতকার্য হয়, সমাজকে দোষী করা অথবা সমাজের ওপর রাগ পোষণ করার চাইতে নিজের অক্ষমতার জন্য লজ্জিত হয়। একজন ব্যক্তি যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক দর্শনে অভ্যস্ত হয়ে থাকে তাহলে সমন্বিত প্রচেষ্টায় কিছুই অর্জন করা যায় না বলে মনে করে। ক্ষমতার অধিকারী যারা তারা যখন সামাজিক পদ্ধতির সুযোগ গ্রহণ করে অর্থ সম্পদের মালিক হয় এবং বিশ্বজোড়া প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, তাদের বিরুদ্ধে কোন সার্থক বিরোধিতা সম্ভব হয়ে ওঠেনা।