অসভ্য গোত্রগুলো প্রায়ই অসহিষ্ণু এবং সন্দেহপ্রবণ হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে সামাজিক আচার বিচারের খুবই প্রধান্য এবং আগন্তুকদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়। ইতিহাসের প্রাকহেলেনিক যুগের সবটাতেই এ বৈশিষ্ট্য পুরোমাত্রায় বিরাজমান ছিল। বিশেষ করে মিশরে শক্তিশালী পুরোহিততন্ত্রই ছিল জাতীয় ঐতিহ্যের সংরক্ষক। আখনাতোন বিদেশী সিরীয় সভ্যতার কাছ থেকে যে সাবলীল সংশয়বাদ আয়ত্ব করেছিলেন তা দমন করতে সম্পূর্ণ পারঙ্গম ছিলেন। মিনোয়ানের সময়ের অবস্থা যাই থাকনা কেনো গ্রিসেই সর্বপ্রথম বিশ্লেষণাত্মক সহনশীলতার পরিপূর্ণ বিকাশ হয়। এর পেছনের অনেকগুলো ধারাবাহিক কারণের একটি দৃষ্টান্ত হলো বাণিজ্য, বিদেশীদের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখার অভিজ্ঞতা থাকার ফলে এবং বিদেশীদের সঙ্গে সম্বন্দ রাখার তাগিদে তাদের মধ্যে সহনশীলতার প্রয়োজন ছিল। সাম্প্রতিককালের পূর্বপর্যন্ত বাণিজ্য ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন, কুসংস্কার ছিল তখন লাভের প্রতিবন্ধক এবং সকলের সঙ্গে প্রীতির সম্বন্ধ রক্ষা করাই হলো ব্যবসায়ে সাফল্যের নীতি। কিন্তু পরবর্তী গ্রিসের বাণিজ্যম্পৃহার থেকেই, শিল্প এবং দর্শনের উদ্ভব হয়, কিন্তু সামরিক সাফল্যের জন্যে যে পরিমাণ সামাজিক সঙ্গতির প্রয়োজন ছিল তা সৃষ্টি করতে পারেনি। সুতরাং গ্রিকেরা প্রথমে মেসিডোনিয়া এবং পরে রোমানদের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।
আধুনিক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে রোমান পদ্ধতি ছিল নিঃসন্দেহে সমন্বয়ধর্মী এবং অসহনশীল। এখানে আধুনিক অর্থের মানে আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে তারা ধর্মতাত্ত্বিক দিক দিয়ে নয়, সাম্রাজ্যবাদী এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিতেই ছিল সমন্বয়বাদী। সে যাহোক, রোমানদের সমন্বয়বাদ ধীরে ধীরে সংশয়বাদের মধ্যে ডুবে গেলো এবং যা খ্রীষ্টিয় এবং মুসলমান সমন্বয়বাদে রূপ পরিগ্রহ করেছিল। এ সমন্বয়বাদ রেনেসাঁর পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত প্রবল ছিল। পশ্চিম ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তি এবং শিল্পোতকর্ষময় একটি সংক্ষিপ্ত যুগের জন্ম রেনেসা দিয়েছিল; যখন রাজনীতিতে অব্যবস্থা এবং সাদাসিধা মানুষদেরকে বোকা বানিয়ে ধর্মযুদ্ধে পরস্পর পরস্পরকে নির্মমভাবে হত্যা করানো হচ্ছে। ইংল্যাণ্ড, ইংল্যাণ্ডের মতো ব্যবসায়ী জাতিসমূহ সর্বপ্রথমেই সংস্কার এবং প্রতিসংস্কার আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসে এবং আলাদা হবার জন্য অন্যান্যদের সঙ্গে সংগঠিত হয়ে রোমের বিপক্ষে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সহনশীলতার পরিচয় দান করল। প্রাচীন গ্রিসের মতো ইংল্যাণ্ডও প্রতিবেশী দেশসমূহে একটা সফল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল এবং যা গণতন্ত্র ও পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থার জন্য যে পরিমাণ সংশয়বাদের প্রয়োজন তা সৃষ্টি করেছিল। আজকের অসহিষ্ণু যুগে তা সম্ভব নয় বলে মানুষ ফ্যাসিবাদ এবং বলশেভিক মতবাদকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে চায়।
উনবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের যে সাধারণ ধারণা তারও চেয়ে অধিক ১৬৮৮ সালের বিদ্রোহের দর্শন জন লকের লেখায় যা প্রকাশ পেয়েছে, তার মধ্যে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি। এই দর্শন ১৭৭৬ সালে আমেরিকা এবং ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসিদেশে প্রভুত্ব বিস্তার করে এবং তার পরে পাশ্চাত্যের প্রায় দেশেই ছড়িয়ে পড়ল। শিল্পবিপ্লব এবং নেপোলিয়নকে পরাজিত করে ইংল্যাণ্ড যে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছিল তাই ছিল এ দর্শনের ব্যাপক প্রসারের কারণ।
মানুষ ধীরে ধীরে এ ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য অসঙ্গতির বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে। লক এবং উনবিংশ শতাব্দীর উদারনৈতিক মতবাদ ছিল শিল্পনির্ভর নয়, বাণিজ্যনির্ভর। নিখুঁতভাবে যে দর্শন শিল্পনির্ভর তা সমুদ্রবিহারী অভিযাত্রী বণিকের দর্শনের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। শিল্পবাদ সংযোজনধর্মী বৃহৎ অর্থনৈতিক এককের সৃষ্টি করে সমাজকে অধিকতর যান্ত্রিকতায় রূপান্তরিত করে এবং ব্যক্তির আশা আকাঙ্খর অবদমনের দাবি করে। তদুপরি, শিল্পবাদের অর্থনৈতিক সংগঠন কাঠামোর দিক দিয়ে এ পর্যন্ত কতিপয় ব্যক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং আপাত-বিজয়ের মুহূর্তটিকে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের নিরপেক্ষ রূপ দান করেছে। এ সকল কারণে মনে হয় যে আমরা সমন্বয়শীল অসহিষ্ণু নতুন একটি যুগের মধ্যে প্রবেশ করছি। যার ফল অন্যান্য যুগের দর্শনের সংঘাতের মত এযুগে যে যুদ্ধ হবে, তা বলাবাহুল্য মাত্র। আমি এই সম্ভাবনাকেই তুলে ধরে দেখাতে চাই।
আজকের পৃথিবীতে দুটো শক্তিশালী রাষ্ট্র রয়েছে, একটি সোভিয়েট রাশিয়া এবং অন্যটি আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র। তাদের লোকসংখ্যা সমান এবং যে সকল দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের লোকসংখ্যাও প্রায় তাদের সমান। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপসহ বাকি আমেরিকা মহাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং রাশিয়া তুরস্ক,ইরান এবং চীনের অধিকাংশকেই নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিভেদ মধ্যযুগের খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের বিভেদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সে আগের এত নীতির দ্বন্দ্ব, নির্জলা হিংসা এবং বিস্তৃত এলাকা সবকিছু এখনও বর্তমান। মধ্যযুগে খ্রিষ্টান শক্তির সঙ্গে মুসলমান শক্তির যেমন যুদ্ধ হয়েছিল তেমনি এ দুটো শক্তিমান শিবিরের মধ্যেও যুদ্ধ হবে। কিন্তু আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে শীগগীর অথবা বিলম্বে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তার নিরসন করা হবে এবং পরস্পরের মধ্যে ক্লান্তিজনিত সংঘর্ষ ছাড়া আর কিছুই হবে না। এ সংঘর্ষের ফলে দু’দলের একদল বিজয়ী এবং বিজয়ের ফলে যে সুবিধা আদায় করতে পারবে তা আমি মনে করি না। একদল অন্যদলকে ঘৃণা করবে এবং মন্দভাবে বলেই দু’দলের মধ্যে হিংসাত্মক মনোভাব অটুট থাকবে বলে আমি মনে করি এবং তাই হলো নীতিযুদ্ধের একটি বৈশিষ্ট্য।