সবচেয়ে বেশি ভয়ের কারণ হলো, মনোবিজ্ঞান ক্ষমতাসীনদের হাতে নতুন ধরনের অস্ত্র তুলে দেবে। তারা ভীরুতা এবং বশ্যতা শিক্ষা দিতে সক্ষম হবে এবং ধীরে ধীরে পোষমানা জম্ভর মত করে ফেলবে। আমি ক্ষমতাসীনদের নামে শুধু পুজিপতিদের কথা বলছিনা, সমস্ত সরকারি কর্মচারী, এমনকি ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিকদল সকলেরই কথা বলছি, প্রত্যেক অফিসার এবং প্রত্যেক ক্ষমতাসীন ব্যক্তি চান যে অনুসারীরা তার কাছে অনুগত থাকুক। তারা যদি তাদের সুখের ধারনা অনুসারে নিজস্ব ভাবধারার প্রসার করতে চায়, তাহলে তিনি রুষ্ট হন। অতীতের উত্তরাধিকারনীতি নিশ্চয়তা প্রদান করেছিল যে শাসক শ্রেণী অলস এবং অযোগ্য হবে, যার ফলে অন্যেরা সুযোগ পেয়ে যাবে। প্রত্যেক সময়ের শাসক শ্রেণী যুগের অত্যুৎসাহী এবং কর্মী ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে যদি নির্বাচন করা হয় তাহলে তারা নিজের চেষ্টায় মাথা তুলবে। এ ব্যপারে সাধারন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বড়ো বেশী ঝাপসা। পৃথিবীতে কেউ অলসের পক্ষে সমর্থন করে কোন কিছুর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। যারা অপরের ব্যাপারে নাক গলায় না অলস বলতে আমি তাদের কথাই বলছি। পৃথিবীর সমস্ত শক্তি যেখানে প্রতিদ্বন্দিতার পুরস্কার সেখানে যদি শান্তিকামী মানুষেরা পাত্তা অর্জন করতে চায়, তাহলে তাদেরকে যৌবনের নির্ভীকতা এবং উদ্যমশীলতা শিক্ষা করতে হবে। সম্ভবতঃ গণতন্ত্রের যুগ এখন অতিক্রান্ত। তাই যদি হয় মনোবিজ্ঞান দাসদের আবদ্ধ করে রাখার শৃঙ্খলের আঙটা হিসেবে কাজ করবে। অত্যাচার করবার কৌশলে পুরোপুরি দক্ষতা অর্জন করার আগে গণতন্ত্রকে নিরাপদ করবার প্রয়োজন সে জন্য।
শুরুতে আমি বিজ্ঞানের তিন রকমের প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছি। তাতে পুনরায় প্রবর্তন করলে এটা স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে মনোবিজ্ঞান শক্তির অধিকারী কোন কাজে আসবে তা আমরা কল্পনা করতে পারিনে, যতক্ষণ পর্যন্ত না কী ধরণের সরকার আমাদের গঠন করতে হবে সে সম্বন্ধে ওয়াকেবহাল না হই। প্রত্যেক রকমের বিজ্ঞানের মত মনোবিজ্ঞানও শাসকদের হাতে নতুন রকম অস্ত্র প্রদান করবে। তার মধ্যে প্রধানতঃ উল্লেখযোগ্য হবে শিক্ষা এবং প্রোপাগাণ্ডার অস্ত্র, উভয়টাকে পরিপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে এমনভাবে গড়ে তোলা যায়, যাতে দু’টোই বাস্তবিকভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। যদি ক্ষমতাসীনেরা শান্তিকামনা করে, তাহলে তারা শান্তি কামী জনতার সৃষ্টি করতে পারবে। আর যদি যুদ্ধ চায়, তাহলে পোষমানা জনসাধারণের সৃষ্টি করবে। যদি তারা বৃদ্ধিবৃত্তির প্রসার করতে চায় করতে পারবে, যদি বোকামো এবং মূর্খতা প্রচার করতে চায় তাও পারবে। সুতরাং এক্ষেত্রে ভবিষ্যৎবাণী করা রীতিমতো অসম্ভব।
কল্পনায় মনোবিজ্ঞান সম্ভবতঃ দু’টো পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়া করবে। একদিকে ব্যাপকভাবে ডিটারমিনিজম বা নিয়ন্ত্রনবাদকে গ্রহণ করা হবে। অধিকাংশ মানুষ এখন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে আরাম বোধ করে না, তার কারণ হলো আবহাওয়াবিজ্ঞান। কিন্তু তারা যখন ভালো হৃদয়ের জন্য প্রার্থনা করে তখন তত খারাপ লাগেনা। বৃষ্টির যা কারণ ভালো হৃদয়েরও তাই যদি কারণ হয়ে থাকে তাহলে প্রভেদ থাকবেনা। যে লোক ডাক্তার ডেকে খারাপ আকাথা থেকে মুক্ত না হয়ে ভালো হৃদয়বিশিষ্ট হওয়ার জন্য প্রার্থনা করে তাকে কপট বলে মার্কা মেরে দেয়া যেতে পারে। যদি যে কেউ হার্লি খ্রিষ্টের সাধুর কাছ থেকে কয়েক গিনি দিয়ে প্রার্থনা করে ভালো হয়ে যেতে পারে, তাহলে তাকে কপট ছাড়া আর কি বলা যায়। নিয়ন্ত্রণবাদের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবতঃ কর্মপ্রেরণা কমে যাবে এবং সাধারণের মধ্যে নৈতিক অলসতা আসবে, কিন্তু এরকমের ফলাফল যুক্তিসঙ্গত নয়। এ আমাদের পক্ষে লাভজনক হবে কি ক্ষতিকারক হবে তা আমরা বলতে পারি না, যেহেতু প্রমাদপূর্ণ মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বিত নৈতিক প্রচেষ্টার কি ভালো ফল হবে না খারাপ ফল হবে তা আমি বলতে পারিনে। অন্য দিকটি বস্তুর সঙ্গে নৈতিক এবং দার্শনিক কোন বাঁধন থাকবেনা। আবেগসমূহ যখন সর্বজনস্বীকৃত সক্রিয় বিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে রূপান্তরিত হবে তখন আবেগ রাশিকেই অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা হবে। আমার মতে এর ফল মোটামুটি ভালোই হবে, যেহেতু তা সুখের প্রচলিত প্রমাদপূর্ণ ধারণার নিরসন করতে পারবে।
আমাদের জীবনের ধারায় আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে যে সম্ভাব্য পরিবর্তন আনতে পারে তার সম্বন্ধে অগ্রিম কিছু বলার মত দুঃসাহস আমার নেই। একধরণের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করার কোন সঙ্গত কারণ আমি দেখিনা। উদাহরণস্বরূপ নিগ্রোদের কাছে অন্যান্য উৎকর্ষ না আয়ত্ব করে সাদা মানুষের মতো যুদ্ধ করতে শিক্ষা করাই হবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া অথবা বিপরীতভাবে মনোবিজ্ঞান নিগ্রোদেরকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে অনুপ্রাণিত করবে। এই দুই সম্ভাবনা ভিন্ন ভিন্ন পৃথিবীর জন্ম দিতে পারে : একটা বাস্তবায়ন হবে, না কোনটাই হবে না, সে বিষয়ে অনুমান করার কোন উপায় নেই।
উপসংহারে মনোবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ বাস্তব গুরুত্ব হবে তা সাধারণত মানুষ মানুষীকে সত্যিকারের সুখ কিসে তার একটি ধারণা প্রদান করবে। প্রধান প্রধান ব্যাপারে মানুষ যদি সুখী থাকে তাহলে তারা অসন্তোষ, দ্বেষ এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের শিকারে পরিনত হবে না। জীবনের প্রয়োজনীয় চাহিদা ছাড়াও কমপক্ষে মধ্যবিত্ত এবং মজুরদের যৌন এবং পিতৃত্বের স্বাধীনতা থাকা চাই। আমাদের প্রবৃত্তির জ্ঞানকে সার্বজনীন করে তোলার কাজ বর্তমান জ্ঞানের সাহায্যে কঠিন হবে না, যদি না আমরা, যারা সুখ পায়নি এবং অন্যকেও পেতে দেয়নি তাদের হিংসুটে আবেগের দ্বারা প্রবৃত্তিগুলোকে ধ্বংস না করি এবং সুখ যখন সার্বজনীন হয়ে পড়বে তখন নিজেই নিজের অস্তিত্ব ঘৃণা এবং ভীতির বিরুদ্ধে আবেদনের মাধ্যমে রক্ষা করতে সম্ভবপর হবে বর্তমান রাজনীতি আঁশে শাঁসে যে হিংসা বিদ্বেষ তাও নিরালম্ব হয়ে পড়বে। কিন্তু মনোবিজ্ঞান যদি অভিজাততন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত হয় তাহলে পুরনো দোষত্রুটিাকে আবার জাগিয়ে তুলবে এবং তাও নিরালম্ব হয়ে পড়বে এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হবে। পৃথিবীতে সুখ সন্তুষ্টি বিধান করার এমন পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে, যে মানুষের উৎপত্তির সময় থেকে তাবৎ ইতিহাসে তার জুড়ি মেলেনা; কিন্তু প্রাচীন অসঙ্গতি লোভ, দ্বেষ এবং ধর্মীয় নিষ্ঠুরতা সে সুখের প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে, এর ফলাফল কি হবে আমি জানিনা, কিন্তু মনে করি খারাপ হোক, ভালো হোক তা এমন হবে যা মানুষের অনুমান কল্পনার বাইরে।
১৬. নীতিযুদ্ধের বিপত্তি
মানবজাতির ইতিহাসে বিভিন্নভাবে সামরিক আলোড়ন ঘটে গেছে। উৎসাহী ব্যক্তিরা তার যে কোন একটি ইতিহাসের চাবিকাঠি বলে ধরে নিতে পারেন। আমি যে আলোড়নটির ওপর আলোচনা করতে চাই সম্ভবতঃ তা কম গুরুত্বসম্পন্ন নয়। আলোড়নের ফলে ইতিহাসের সমন্বয় এবং অসহনশীলতা থেকে বিশ্লেষণ এবং সহনশীলতায় উত্তরণ, তারপর আবার পূর্বাবস্থায় প্রত্যাগমন আমার প্রস্তাবিত বিষয়।