অযৌক্তিক বিশ্বাস শুধুমাত্র অসভ্যদের মধ্যে সীমিত নয়। মানব সমাজের অধিকাংশ মানুষ, যাদের ধর্মমত আমাদের মতো নয়, আমরা বলতে পারি ওগুলো অযৌক্তিক ভিত্তিহীন। রাজনীতিবিদ ছাড়া আর যারা রাজনীতিতে আগ্রহশীল, অসংখ্য প্রশ্নে তারা সংস্কারমুক্ত একজন মানুষ সম্পর্কে কোন যুক্তিসম্মত ধারণা পোষণ করতে পারে না। পরাজয়ের যতই ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকুক না কেন, নির্বাচনের সময় স্বেচ্ছাসেবকেরা আশা পোষণ করে যে আপন পক্ষের জয় অবশ্যম্ভাবী। ১৯১৪ সনে জার্মানির অধিকাংশ নাগরিক বিন্দুমাত্র সন্দেহ না রেখে জার্মানির সর্বৈব বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত আশা পোষণ করেছিল, সে ক্ষেত্রে বাস্তব সত্যের সঙ্গে সংঘাতে স্বপ্ন মার খেয়েছে। অজার্মান ঐতিহাসিকেরা যদি কোনকারণে সে ইতিহাস রচনা থেকে বিরত থাকেন, তাহলে স্বপ্নের আবার পুনর্জাগরণ ঘটবে। প্রারম্ভিক বিজয়ের কাহিনী বারবার নিনাদিত হবে এবং অন্তিম পরাজয়ের কথা বেমালুম ভুলে যাবে।
শিষ্টাচার হলো মানুষের বিশ্বাসের সেই স্তরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, বিশেষভাবে যা তার অথবা তার দলের অন্যান্যদের মেধার পরিচিতি বহন করে। যেখানেই থাকুক না কেননা বিশ্বাসের একটা বেষ্টনী প্রত্যেক মানুষকে ঘিরে থাকে। গ্রীষ্মের দিনে মাছির মতো এ সবও মানুষের সঙ্গে সঙ্গে গমন করে। এরই মধ্যে কতেক ব্যক্তিগত, তাতে ব্যক্তির গুণাবলী সূতাবোধ,বন্ধুপ্রীতি পরিচিতজনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ চরিত্রের গোলাপি সুষমা ইত্যাদি পরিচয় বিধৃত থাকে। তারপর আসে পারিবারিক সংস্কৃতিচেতনার কথা। ইদানীংকালে দুর্লভ তার বাবার ঋজু মনোভঙ্গী, ছেলেমেয়েদের মানুষ করার ব্যাপারে তারা অসম্ভব কড়াকড়ি, যা বর্তমানে পিতামাতার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হবে। স্কুলের খেলাধুলায় তার ছেলেরা কিভাবে আর সকলকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং তার মেয়েরা যেমন যাকে তাকে বিয়ে করে না বসে ইত্যাদি, ইত্যাদি। তার ওপরে আসে তার শ্রেণীগত বিশ্বাসের কথা, যা তার সামর্থের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সামাজিক এবং অথবা সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান কিংবা নৈতিকতার দিক দিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি কাক্ষিত। যদিও সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে প্রথমটি দ্বিতীয়টির চেয়ে এবং দ্বিতীয়টি তৃতীয়টির চেয়ে অধিকতর কাম্য। জাতিগতভাবে মানুষ কতগুলো আনন্দিত কল্পনাকে বিশ্বাস বলে গ্রহণ করে। মানবমনের গভীর আকুতির ভাষারূপ দিতে গিয়ে একটি কথার মধ্যে মি. পডস্ন্যাপ (Mr. Podsnap) বলেছেন, ওহ্ বিদেশী জাতিগুলো, তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে আমরা দুঃখিত, তারা এই করে, এই তাদের রীতি। নিরঙ্কুশ মানবিক অথবা পাশব সৃষ্টির তুলনায় সর্বনরের সাধারণ পরিচয়বিধৃত থিয়োরিসমূহে শেষপর্যন্ত আমাদের আসতে হয়। মানুষের আছে আত্মা, পশুর তা নেই। মানুষ বিবেচনাসম্পন্ন জীব বলেই তার কোন বিশেষ নির্দয় এবং প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজকেই পাশবিক বলা হয়, যদিও সেসকল কাজ আদতে মানবিক। স্রষ্টা তো আপন স্বরূপের প্রতিরূপেই যদিও মানুষ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং মানুষের কল্যাণই হলো ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির চরম উদ্দেশ্য।
.
সুতরাং আনন্দদায়ক বিশ্বাসসমূহের অনুকূলে কাজ করে যাই আমরা। কারো সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক রাখতে হলে এ সকল বিশ্বাস যেগুলো তার নিজস্ব, পারিবারিক জাতীয় এবং যেগুলো সকল মানুষের জন্য সমানভাবে আনন্দদায়ক তার প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কোন মানুষকে সামনে কিছু না বলতে পারলে তার পেছনেও কিছু বলা উচিত নয়। মনের সঙ্গে মনের দূরত্ব যত বেশি বাড়ছে মতের বিভিন্নতাও বাড়ছে তত বেশি। নিজের ভায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় তার পিতামাতার প্রতি সচেতন শ্রদ্ধাশীলতা পোষণ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিদেশীদের সঙ্গে কথা বলার সময় শিষ্টাচার প্রদর্শনের প্রয়োজন হয় সর্বাপেক্ষা বেশি, যা উগ্র স্বদেশীদের কাছে অসম্ভব, যেহেতু তারা তাতে অভ্যস্ত নয়। বাইরে ভ্রমণ করেনি, এমন একজন আমেরিকানের সঙ্গে একবার আমার দেখা হয়েছিল। সামান্য কয়েকটি বিষয় ছাড়া বৃটিশ সংবিধানের সঙ্গে আমেরিকান সংবিধানের কোন প্রভেদ নেই, একথা শুনে ভদ্রলোক ভয়ানক চটে গিয়েছিলেন। পূর্বে তিনি কখনো এরকম মতামত শোনেন নি এবং কেউ যে সে মতামত গ্রহণ করতে পারে তাও ছিল তার কল্পনার অতীত। আমরা দুজনেই শিষ্টতা দেখাতে অক্ষম হয়েছিলাম বলে ফল দাঁড়ালো মারাত্মক।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে শিষ্টাচার প্রদর্শনের অক্ষমতা খুবই খারাপ, কিন্তু প্রাচীন কুসংস্কারকে ছেদন করবার কারণে শিষ্টাচার প্রদর্শন না করাটা খুবই প্রশংসনীয়। দু’উপায়ে আমাদের স্বভাবজ বিশ্বাসই সমূহ পরিশুদ্ধি অর্জন করে। প্রথম হলো বস্তুর সঙ্গে বিশ্বাসকে যাচিয়ে নেয়ার পদ্ধতি, যেমন অনেকে বিছুটিকে ব্যাঙের ছাতা বলে মনে করে কষ্ট পেয়ে থাকে। দ্বিতীয়তঃ আমাদের বিশ্বাস সোজাসুজি বস্তুর সঙ্গে সংঘাত না বাধিয়ে ভিন্নমতের কারো সঙ্গে যখন সংঘাত বাধায় তা যাচাই করা। কেউ মনে করে শুকরের মাংস খাওয়া আইনানুগ আর কেউ গরুর মাংস খাওয়াকেই আইনানুগ মনে করে না। মতামতের এই বিভিন্নতার স্বাভাবিক পরিণতি হলো রক্তপাত। কিন্তু সে সঙ্গে বেরিয়ে আসবে একটি বিবেচনাপ্রসূত মাঝামাঝি পথ এবং তা অনেকটা এরকম, দুটোর কোনটাতেই দোষ নেই। শিষ্টাচারের সঙ্গে তার সম্বন্ধ হলো খুবই সুনিবিড়। তার মানে হলো যাদের সঙ্গে কথা বলছি তাদের চেয়ে নিজেদেরকে এবং নিজেদের ধনসম্পদকে নগণ্য দেখার ভান করা। একমাত্র চীনদেশেই এ নীতি সর্বত্র ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়। আমাকে বলা হয়েছে যদি কোন চীনাকে তার স্ত্রী এবং সন্তানের স্বাস্থ্য পানের উদ্দেশ্যে কোন মান্দারিন যদি আক্রমণ করেন, তিনি বলবেন, আমার স্ত্রীর মতো একজন কৃপাকাঙ্খীনি রোগাক্রান্তা খর্বাঙ্গীনির স্বস্থ্যোলাসে আপনার মতো একজন মহানুভব ব্যক্তি আহবান করেছেন, সেহেতু আমার আনন্দের অবধি নেই। এ ধরণের লেহাজ দুরস্ত করে বলার জন্যে জীবনের আয়েশ এবং সম্মান দুইয়েরই প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান ব্যবসা আর রাজনীতির দ্রুত সংযোগের ব্যাপারে তা একেবারে অসম্ভব। ধাপে ধাপে অন্য মানুষের সঙ্গে সংসর্গের ফলে সবচেয়ে কার্যকরী ধারণা ছাড়া আর সবগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, ব্যক্তিগত বিশ্বাস ভাইয়ের সঙ্গে মেলামেশার ফলে নষ্ট হয়ে যায়, পারিবারিক সংস্কার স্কুলের সতীর্থদের প্রভাবে নষ্ট হয়, শ্রেণীগত সংস্কার রাজনীতির প্রভাবে এবং জাতিগত সংস্কার যুদ্ধে পরাজয় অথবা অর্থনীতিতে মার খাওয়ার ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু মানবিক ধরণা সবসময়ে অটুট তাকে এবং মানুষের আদানপ্রদানের যে ক্ষেত্র তাতে নতুন সংস্কার জন্ম নেয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে। এ ধরণের ভ্রান্তধারণার আংশিক পরিশুদ্ধি মিলে বিজ্ঞানে, কিন্তু তা কখন আংশিকের বেশি হতে পারে না। কিছু সংখ্যক বিশ্বাসের ভিত্তির উপর দাঁড় না করালে পরে বিজ্ঞান নিজের আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।