গোঁড়া এবং মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে মনঃসমীক্ষকেরা বলে যে যৌনবোধ হচ্ছে মানুষের একটি মৌলিক প্রবৃত্তি। তারা আরো বলে যে ক্ষমতাপ্রীতি হলো পীড়িত যৌন-কামনাবোধের এক ধরনের বিকৃত বিকাশ! যে মানুষ এতে বিশ্বাস করে সে লোক অর্থনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী যে মানুষ, তার চাইতে আলাদা কাজ যে করবে একথা তো দিবালোকের এত স্পষ্ট। বিশেষ বিশেষ রোগে আক্রান্ত হলে, প্রত্যেকেই জীবনে সুখী হতে চায়। কিন্তু অধিকাংশ সুখ কিসের মধ্যে তার কতকগুলি প্রচলিত থিয়োরিকে সারসত্য বলে গ্রহণ করে থাকে। যদি মানুষ চিন্তা করে সম্পদের মধ্যে সুখ রয়েছে, তারা যখন যৌনক্রিয়াকে অপরিহার্য মনে করবে সে অনুসারে কাজ করবেনা। উভয় মতামতের কোনটাকেই আমি সত্য বলে মনে করিনা, কিন্তু নিশ্চিতভাবে মনে করি যে পরবর্তী মতামত অধিকতর কম ক্ষতিকর, কি করলে সুখ পাওয়া যায় তার প্রকৃত থিয়োরির কিসের প্রয়োজন। কোন মানুষ যদি তার জীবনের বৃত্তিকে নির্বাচন করার জন্য তা ব্যবহার করে তাহরে বলতে হবে তিনি থিয়োরি দ্বারা অধিকতর প্রভাবিত হয়েছেন। যদি কোনো ভুল থিয়োরি বর্তমান থাকে, তাহলে সার্থক মানুষেরা অসুখী হবেন; তা তারা নিজেরাও জানবেননা। যে সকল মানুষকে তারা অবচেতনে হিংসা করে তাদেরকে হত্যা করার ইচ্ছায় তাদের হৃদয় ক্রোধে আন্দোলিত হয়ে ওঠে। অত্যাধুনিক রাজনীতি, সাধারণতঃ অর্থনীতির ওপর যা নির্ভরশীল, প্রবৃত্তির সন্তুষ্টির অভাব জনপ্রিয় মনস্তত্ত্বের প্রমাদের কারণেই হয়ে থাকে।
যৌন-প্রবৃত্তি যে সবকিছু তা আমি মনে করতে পারিনা। রাজনীতিতে যৌনপ্রবৃত্তিকে যখন থেতলিয়ে দেয়া হয় তখনই বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যুদ্ধে অবিবাহিত বয়স্কদের মধ্যে একধরণের হিংস্রতা এসে থাকে এবং তা অংশতঃ একারণে যে যুবকেরা তাদেরকে অবজ্ঞা করে, তারা অস্বাভাবিকভাবে ঝগড়াটে হয়ে থাকে। আমার মনে পড়ে আর্মিষ্টিসের পরে ট্রেনে সালটাশ সেতু অতিক্রম করার সময় নিচে আমি অনেকগুলো নোঙ্গর করা যুদ্ধজাহাজ দেখেছিলাম। দু’জন অবিবাহিতা বয়স্থা কুমারি পরস্পরকে বলতে শুনেছিলাম, তাদের সকলকে অলসভাবে শুয়ে থাকতে দেখলে দুঃখ হয়না, যৌনপ্রবৃত্তি পরিতৃপ্তি হলে রাজনীতিতে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। আমার বলা উচিত যে রাজনীতিতে ক্ষুধা তৃষ্ণাকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়া হয়। পিতৃত্বের প্রয়োজন অপরিসীম, কেননা পরিবারের প্রয়োজন রয়েছে। এমনকি রিভার্স বলেছেন যে পরিবারই ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎস। কিন্তু পিতৃত্বকে অবশ্যই কোনমতে যৌনকামনার সঙ্গে এক করে মিলিয়ে ফেলা যাবেনা।
প্রবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সংরক্ষণ ও প্রসারের জন্য অনেক কিছু থাকতে পারে, যেগুলো আমরা গৌরব বলে আখ্যায়িত করতে পারি। সেগুলো হলো ক্ষমতাপ্রীতি, গরিমা, প্রতিদ্বন্দিতা ইত্যাদি। স্পষ্টতঃ রাজনীতি সহনশীল জীবনযাপনের অবস্থা সৃষ্টি করতে চায়; তাহলে এ গৌরবের প্রবৃত্তি সমূহকে পোষ মানিয়ে রাখা একান্তই প্রয়োজন এবং এমন শিক্ষিত করে নেয়া উচিত যাতে করে নির্দিষ্ট গণ্ডীর বাইরে আসতে না পারে।
আমাদের মৌলিক প্রবৃত্তিসমূহ ভালো অথবা মন্দ দু’টার কোনটাই নয়, সেগুলো নীতিগতভাবেই নিরপেক্ষ। শিক্ষার এমন লক্ষ্য হওয়া উচিত, যাতে সেগুলো ভালো দিকে মোড় নেয়। খ্রিষ্টানেরা এখনো পুরনো পদ্ধতি, এগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয় তাতে বিশ্বাস করে। নতুন প্রক্রিয়ানুসারে সেগুলোকে শিক্ষিত করে তোলা হয়। ক্ষমতাপ্রীতির কথা ধরা যাক, সেখানে খ্রিষ্টানদের অবদমিত নীতির কথা প্রচার করে লাভ নেই। তাতে প্রবৃত্তিসমূহ স্পষ্ট রূপ ধারণ করবে। যা আপনি করবেন সে উদ্দেশ্যে সুবিধাজনক একটি রাস্তা আপনাকে করতেই হবে। প্রকৃত অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তির হাজারোভাবে যথা নির্যাতন, ব্যবসা, রাজনীতি, বিজ্ঞান, শিল্পচর্চা ইত্যাদি যখন সাফল্যজনকভাবে করা হয়, তাহলে অতি সুচারু পরিতৃপ্তি বিধান করা যায়। একজন মানুষ যার ক্ষমতাপ্রীতি রয়েছে তার বাস্তব রূপ দেবার জন্যে যৌবনে যে সকল বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছে তার মধ্যে একটি পছন্দ করে সে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবে। আমাদের পাবলিক স্কুল সমূহের উদ্দেশ্যে অত্যাচার করা ছাড়া আর কিছু নয়। ফলতঃ সে স্কুলসমূহ সাদা মানুষের বোঝা বইবার মত মানুষের সৃষ্টি করে। যদি এসকল মানুষকে বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগসম্পন্ন করে তোলা হয়, সম্ভবতঃ কঠিনতর কাজটা করতে ভালোবাসে। যেমন সতরঞ্চ খেলোয়ার মমুলি খেলা পছন্দ করবেনা। এভাবে দক্ষতা এবং কলাকৌশলের সাহায্যে প্রবৃত্তিকে শাসনে রাখা যায়।
অন্য একটি দৃষ্টান্ত নিতে পারি, যেমন ভীতিনির্ভর বিপদের চার রকমের প্রতিক্রিয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নটা প্রযোজ্য।
(১) ভয় পাওয়া এবং পলায়ন করা।
(২) রাগ হওয়া এবং সংগ্রাম করা।
(৩) কৌশলের আশ্রয় নেওয়া।
(৪) নিঃসাড় হয়ে যাওয়া।
এটা স্পষ্ট যে মধ্যে তৃতীয়টাই হলো সবচেয়ে উত্তম, কিন্তু তার জন্য খাপ খায়, এমন বিশেষ ধরনের কৌশলের প্রয়োজন। দ্বিতীয়টাকে সাহস নাম দিয়ে জঙ্গীবাদী ব্যক্তি, স্কুল শিক্ষক এবং ধর্মাধ্যক্ষেরা প্রশংসা করে থাকেন। প্রত্যেক রকমের শাসকশ্রেণীর নিজস্ব শ্রেণীকে সাহসী করে গড়ে তোলার লক্ষ্য থাকে, যাতে করে তারা অধীনস্থদের ভীতু এবং পালনীয় মনোবৃত্তিসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারে। আমাদের সময়ের আগে নারীজাতিকে শঙ্কাকুলা করে গড়ে তোলা হতো। অপকৃষ্ট বৃত্তি যে সামাজিক ভাবে নমনীয় এবং হামবড়ামীর রুপ পরিগ্রহ করেছে এখনো তা শ্রমিকদের মধ্যে দেখা যাবে।