তবে আপনারা বলবেন, আপনি শিক্ষাকে বেশ মজার অর্থেই ব্যবহার করছেন। একটা মাছকে বিকৃত করা একটা ছেলেকে ল্যাটিন ব্যাকরণ শেখানো এ দু’য়ের মধ্যে প্রভেদ কিসের? আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আমার কাছে দু’টাই একরকম। উভয়টিই ছাত্রের আনন্দের পক্ষে ক্ষতিকারক। সে যাহোক, একে শিক্ষার সংজ্ঞা বলে মেনে নেয়া যায় না। শিক্ষার আসল অর্থ হলো, পরিচালকের নির্দেশক্রমে সংশোধিত একপ্রকারের (মৃত্যু ছাড়া) ইন্দ্রিয়বৃত্তিক পরিবর্তন। অবশ্য পরিচালক বলে থাকেন যে শিক্ষার্থীর মঙ্গলই হচ্ছে তার আকাঙ্খা। নিরপেক্ষভাবে যাচাই করে দেখলে তার মন্তব্যের যে কোন সত্যতা আছে তা ধরা পড়েনা।
এখন ইন্দ্রিয়বৃত্তিক পরিবর্তন করার জন্য অনেকগুলো পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়েছে। আপনি ইচ্ছা করলে মাছের অস্তিত্বে পরিবর্তন করতে পারেন, যাতে করে একটা চোখ হারিয়েও বেঁচে থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ একজন মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে ঔষধ প্রয়োগ করে রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তন সাধন করতে পারেন। মামুলি পদ্ধতি শেষ ধরনের পরিবর্তনের বিশেষ দিক। বর্তমানে শিক্ষার সবকিছু উপদেশ বা অনুজ্ঞা ব্যতিরেকে যন্ত্রটি যখন খুবই তরুন তখনই ছাপ ফেলতে সক্ষম বলে প্রমান করা হয়। এ-ধারনা অনুসারে মানুষের শিক্ষা শুরু হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো চার বছরের পর। কিন্তু আমি যেমন আগে বলেছি এখনো বলছি জন্মের পূর্বে শিক্ষা এখনো সম্ভব হয়নি,যদিও তা এশতাব্দীর শেষদিকে সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
বাল্যকালে শিক্ষা দেবার দুটো পদ্ধতি রয়েছে। একটা রাসায়নিক এবং অন্যটা সাঙ্কেতিক পদ্ধতি। যখন আমি রাসায়নিক কথাটা বলি তখন সম্ভবতঃ আমাকে জবরদস্ত বস্তুবাদী বলে ভাবা হবে। যদি আমি বলতাম প্রত্যেক সতর্ক মা শিশুকে যে সকল স্বাস্থ্যকর পথ্য পাওয়া যায় তাই খেতে দেবে, তাহলে আমাকে বস্তুবাদী ভাবা হতো না। রাসায়নিক কথাটাকে ঘুরিয়ে বললে তাই দাঁড়ায় বৈকি, যে সকল সম্ভাবনা কম বেশি ইন্দ্রিয়বোধ সম্বন্ধীয় সেগুলোর সঙ্গে আমার কারবার। পথ্যের সঙ্গে উপযুক্ত ঔষধ অথবা ইনজেকশনের সাহায্যে রক্তের মধ্যে সারবান উপাদান প্রবিষ্ট করিয়ে দিলে বুদ্ধিবৃত্তির বৃদ্ধি অথবা আবেগের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটানো যায়। সকলেই জানে যে মুখতার সঙ্গে আয়োডিনের অভাবের সম্পর্ক রয়েছে। সম্ভবতঃ আমরা দেখতে পাবো যে তারাই হচ্ছে বুদ্ধিমান মানুষ যারা বাল্যকালে পথ্যের সঙ্গে অল্প পরিমাণে দুপ্রাপ্য উপাদান কড়াই, বাসন অপরিষ্কার থাকার ফলে খেতে পেয়েছে। অথবা গর্ভাবস্থায় মায়ের পথ্যের থেকে সে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের সঞ্চার হয়েছে, এ বিষয়ে আমার পরিপূর্ণ জ্ঞান নেই, শুধু আমি লক্ষ্য করেছি যে মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার চাইতে সরীসৃপকে শিক্ষা দেওয়া অনেক বেশি সহজ। তার প্রধান কারণ সরীসৃপের আত্না আছে তা আমরা কল্পনা করিনে!
বাল্যকালে শিক্ষার মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা জন্মের আগে কখনো শুরু হতে পারে না। কারণ, শিক্ষার প্রধান কাজ হলো স্বভাব গঠন। জন্মের আগে আয়ত্ব করা স্বভাবের কোন প্রভাব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জন্মের পরে থাকতে পারে না। কিন্তু শৈশবের চরিত্র সংগঠনের বেলায় তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে, সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নেই। যারা দেহের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া দিয়ে মনকে বিচার করে এবং যারা মনকে প্রত্যক্ষভাবে দেখে তাদের মধ্যে যে বিরোধ আছে, আমার মনে হয় তার কোন প্রয়োজন নেই। প্রাচীনপন্থী ডাক্তার খ্রিষ্টান হলেও আমাদের শারীরিক অবস্থাই দায়ী এবং সে অবস্থাকে দূরীভূত করলে রোগী আরোগ্য হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে মনঃসমীক্ষকেরা সবসময় মনস্তাত্ত্বিক কারণই অনুসন্ধান করেন এবং সেগুলোকে বিন্যস্ত করতে চেষ্টা করেন। এ সমস্ত বিষয়টা মন এবং বস্তুর দ্বৈত-সত্তার মধ্যে দোলায়মান, আমার মতে তা ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। কোন কোন সময়ে সেগুলোকে মানসিক কারণ বলে থাকি তা উদ্ভাবন করা সহজসাধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের মনে করা উচিত যে দু’ধরণের প্রতিক্রিয়াই সবসময়ে বর্তমান। কোন বিশেষ ক্ষেত্রে যখন কোন লক্ষণ আবিষ্কার হয় তার সাহায্যে অনুসন্ধান করাটাই যুক্তিসঙ্গত বলে আমার ধারণা। এ ক্ষেত্রে আয়োডিনের সাহায্যে মুগ্ধতা নিরসন এবং অন্যক্ষেত্রে ফোবিয়ার রোগীকে আরোগ্য করা মধ্যে কোন অসঙ্গতি নেই।
যখন আমরা রাজনীতি সম্বন্ধে একটা মনস্তাত্ত্বিক ধারণা নিতে চাই তখন সাধারণ মানুষের মৌলিক আবেগ প্রবৃত্তি এবং পরিবেশের সাহায্যে কি করে সেগুলোর উৎকর্ষ বিধান করা যায় তা দিয়ে শুরু করাই স্বাভাবিক বলে মনে করি। একশ বছর আগে গোঁড়া অর্থনীতিবিদদের ধারণা ছিল ক্ষমতাপ্রীতিই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের একমাত্র উদ্দেশ্য। কার্ল মার্কসও এই মতামতকে গ্রহণ করেছেন এবং তার ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসের অর্থনৈতিক ভাষ্য রচনা করেছেন। পদার্থবিজ্ঞান এবং শিল্পবাদের থেকে স্বাভাবিকভাবেই এ মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। আমাদের যুগে পদার্থবিজ্ঞানকে কাল্পনিক প্রাধান্য দান করার ফলে কমিউনিস্ট এবং সকল শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবৃন্দ এ মতামতের দ্বারা আচ্ছন্ন! তরুণী রমণীরা জন সাহায্যে প্রতিপালিত মানুষকে বিয়ে করার জন্য আয়ের মায়া ত্যাগ করাতে, বিচারক এবং টাইম পত্রিকা যেমন তাদের আশ্চর্য হওয়ার কথা প্রকাশ করেছিলেন, এ-ও অনেকটা সে রকম। সুখের সম্বন্ধে প্রচলিত মতবাদ, সুখ হলো আয়ের অনুপাতের উপর নির্ভরশীল। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে একজন ধনী অবিবাহিতা বৃদ্ধা একজন বিবাহিতা রমণীর চেয়ে সুখী-এ কথা বলতে হবে। আমাদের প্রথম বক্তব্যকে সত্য প্রতিপন্ন করার জন্য আমরা সাধ্যমত পরবর্তী মহিলার ওপর বেদনা এবং যাতনা আরোপ করি।