রেনেসাঁর সঙ্গে আমরা নতুন প্রভাবের সংস্পর্শে আসি, সে-হলো বিশেষভাবে সাহিত্যের প্রভাব। আমাদের যুগে পর্যন্ত সে প্রভাব ক্রিয়াশীল রয়েছে, বিশেষ করে যারা পাবলিক স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাভ্যাস করেন তাদের মধ্যে বেশি। অধ্যাপক গিলবার্ট মারেকে যখন কোন রাজনৈতিক বিষয়ে মনস্থির করতে হয়, লোকে বলে তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করেন, প্রথমে এ সম্পর্কে ইউরিপিডস কী বলে গেছেন? কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানে আর প্রভাবশীল নয়। রেনেসাঁর সময়ে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে ফরাসি বিপ্লব পর্যন্ত সে ভাবাদর্শের জোড়ালো প্রভাব ছিল। বিপ্লবী বক্তারা সবসময়ে রোমান গুণাবলীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলে ধরতেন। মন্তেস্কু এবং রুশোর মত লেখকদের এমন যুগান্তকারী প্রভাব রয়েছে কোনো সাম্প্রতিক লেখকের মধ্যে পাওয়া যায় না। যা হওয়া উচিত বলে মনে করেছেন তা আমেরিকান সংবিধানে বাস্তবায়িত হয়েছে, একথা যে কেউ বলতে পারে। রোমের শাসনব্যবস্থার কোন দিকটির প্রশংসা নেপোলিয়নের জীবনে ক্রিয়াশীল ছিল তার প্রভাব বিচার করার মতো সক্ষম বিচারক নই।
শিল্পবিপ্লরের সঙ্গে সঙ্গে আমরা একটি নবযুগে পদার্পন করি; তাহলো পদার্থবিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানীরা বিশেষ করে গ্যালিলিও এবং নিউটন এ যুগের পথ প্রশস্ত করেছেন, কিন্তু সে যুগের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক পদ্ধতির প্রতীক হিসেবে রূপ পরিগ্রহ করল! যন্ত্র একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যবিশেষ এবং তা বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন মেনে চলে, (তা না হলে যন্ত্রের সৃষ্টি করা যেতনা) সে বিশেষ উদ্দেশ্যটি সবসময় বাইরের স্থাপিত মানুষের সঙ্গে, বিশেষ করে মানুষের জাগতিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কশীল। কেলভিনিয় ধর্মতত্ত্বে ভগবানের সঙ্গে পৃথিবীর যে সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের সম্পর্ক অবিকল তাই। সম্ভবতঃ সে জন্যই বোধ হয় প্রোটেষ্টান্টদের দ্বারা শিল্পের আবিষ্কার হয়েছিল এবং তাতে এ্যাঙ্গলিকান গির্জার অনুসারীদের তুলনায় ননকনফরমিষ্টরা অধিকতর উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেছিল। যান্ত্রিক সামঞ্জস্যবিধান চিন্তাধারার ওপর প্রগাঢ় প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং এখনো করছে। আমরা পৃথিবী সম্পর্কে যান্ত্রিক মতামত, যান্ত্রিক ব্যাখ্যা, যান্ত্রিক অর্থ সাধারণতঃ প্রাকৃতিক নিয়মকে যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করে থাকি। সম্ভবতঃ অচেতনভাবে যন্ত্রের বাইরের একটি উদ্দেশ্য এবং পরিণতি যন্ত্রের মধ্যে প্রবর্তন করে থাকি। সুতরাং সমাজকে যদি যন্ত্র বলে ধরা হয়, তাহলে ধরে নিতে হয় সমাজবহির্ভূত একটি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সমাজের রয়েছে। ভগবানের গৌরবের জন্য যন্ত্রের প্রচলন হয়েছে একথা বলে আমরা আর সন্তুষ্ট হতে পারিনা, কিন্তু ভগবানের সমার্থক যেমন ব্যাঙ্ক অব ইংল্যাণ্ড বৃটিশ সাম্রাজ্য এবং কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি খুঁজে নিতে আমাদের কষ্ট হয়না। এই বিভিন্ন ধরনের সমার্থক লক্ষ্যের সংঘাতেই আমাদের মধ্যে যুদ্ধ লাগে। এটা মধ্যযুগীয় চন্দ্র সূর্যের ধারণার পূনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়।
পদার্থবিজ্ঞান সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞান বলেই অধিকারী এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তন পরিবেশকেই পরিবর্ধিত করে চলেছে, মানুষকে নয়। পদার্থবিজ্ঞানের মতো সমান সুনির্দিষ্ট এবং মানবজীবনে প্রত্যক্ষ পরিবর্তন আনতে সক্ষম আরেকটি বিজ্ঞানের আবির্ভাব হলে পদার্থবিজ্ঞান অপ্রধান হয়ে পড়বে: মনোবিজ্ঞান সে স্থান দখল করতে পারে। সাম্প্রতিককালে ছাড়া অন্যসময়ে গুরুত্বহীন দার্শনিক বাগাড়ম্বর বলে মনে করা হতো। আমি যৌবনে যে মনোবিজ্ঞান পড়েছি সেগুলো আদৌ পাঠ করার উপযুক্ত নয়। কিন্তু বর্তমানে মনোবিজ্ঞানের দু’রকম আবেদন বা পদ্ধতি স্পষ্টতঃই গুরুত্বসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। তাহলো মনোবিজ্ঞানী এবং মনঃসমীক্ষকদের পদ্ধতি। ফলাফলের দিক দিয়ে এ দু’পদ্ধতি অধিকতর নিশ্চিত এবং নির্দিষ্ট হয়ে উঠেছে যখন স্পষ্টতঃই মনোবিজ্ঞান বর্ধিতহারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
শিক্ষাকে আমরা আলোচ্য বিষয় হিসেবে নিতে পারি। প্রাচীনকালের প্রচলিত মতানুসারে আট বছর বয়স থেকে শিশুদের পড়তে দেয়া উচিত। কিন্তু ল্যাটিন শিক্ষার আগ্রহ হাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের প্রয়োজনীয় মতবাদ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল! তাৎপর্যগত অর্থে এই মতবাদ এখনো শ্রমিকদের মধ্যে প্রবল : ক্ষমতায় থাকার সময়ে তারা নার্সারি স্কুলে শিশুশিক্ষা দেয়ার চেয়ে চৌদ্দ বছরের পরে শিক্ষা দেওয়ার জন্য অধিকতর যত্নবান হয়ে থাকেন। প্রাচীন ব্যবস্তার প্রতি মানুষের দৃষ্টি এখনো কেন্দ্রীভূত বলেই অনেকে শিক্ষা সম্বন্ধে হতাশা পোষণ করে। তারা মনে করে যে, শিক্ষা একজন মানুষকে ভরণপোষনের উপযোগী ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনা! কিন্তু দেখা যাবে যে শিক্ষার বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গী আগেকার তুলনায় অনেক বেশি শক্তি দিয়ে থাকে, অবশ্য শিক্ষা খুবই ছোটকাল থেকে শুরু করতে হবে। মনঃসমীক্ষকেরা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আর জীব বিজ্ঞানীরা তারও আগে থেকে শিক্ষা শুরু করতে চান। আপনি একটি মাছকে দু’দিকে চোখ থাকার বদলে মাঝখানে একটি চোখ বিশিষ্ট করে শিক্ষিত করে তুলতে পারেন (Jennius.Promethus. P 60) কিন্তু তা করতে হলে আপনাকে মাছ জন্মাবার আগে থেকে শিক্ষিত করে তোলার কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত দেখা গেছে যে স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরকে জন্মের পূর্বে শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে বিস্তর অসুবিধা আছে, কিন্তু সেগুলো কাটিয়ে ওঠা যায়।