শেষমেষ ব্যক্তির নৈতিকতার ক্ষতি সামাজিক নৈতিকতার অকথিত ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। যুদ্ধ এবং নির্যাতন সব জায়গায় চলছে এবং তা স্কুলের শিক্ষার কারণেই সহজে সম্ভব হয়ে উঠেছে। ওয়েলিংটন বলতেন, ইটনের খেলার মাঠে ওয়াটালু যুদ্ধ জয়লাভ করেছিল। তিনি অধিকতর নিশ্চিতভাবে বলতে পারতেন ইটনের শ্রেণীকক্ষে ওয়াটালু যুদ্ধজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। মাধ্যমিক এবং মাধ্যমিক স্কুল ছাড়া আমাদের গণতান্ত্রিক যুগে ইটনের প্রয়োজনীয়তা নেই। প্রত্যেক দেশে পতাকা দুলিয়ে সম্রাট দিবস ৪টা জুলাইয়ের উৎসব, অফিসার ট্রেনিং কোর্স ইত্যাদি পালন করার মাধ্যমে বালকদেরকে নরহত্যার শিক্ষা দেয়া হয় এবং বালিকাদের মনে এ বিশ্বাস জাগিয়ে দেয়া হয় যে, সকল মানুষ নরহত্যায় নিয়োজিত তারাই সকল শ্রদ্ধার দাবীদার। কর্তৃপক্ষ যদি শিক্ষক এবং ছাত্রদের মতামতের স্বাধীনতা না দেয় তাহলে অধঃপতনের গহ্বর থেকে বালক বালিকারা মুক্তি লাভ করতে পারবেনা। কোনো কিছুকে গণ্ডীবদ্ধ করলে তা সমস্ত দোষের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মের মত, শিক্ষাবিভাগীয় কর্তারা ছেলেদের পানে মুক্তিকামী আত্নসম্পন্ন মানুষ হিসেবে, দৃষ্টিপাত করেনা, তারা তাদেরকে জাঁকজমকপূর্ণ সামাজিক পরিকল্পনার উপাদান হিসেবে কারখানার ভাবী হাত হিসেবে, যুদ্ধের সঙ্গীন হিসেবে এবং কি হিসেবে যে ভাবেন না তা কল্পনা করা যায় না। প্রত্যেক শিশুকে তার ব্যক্তিত্ব এবং অধিকারসমন্বিত আলাদা লক্ষ্যের অভিসারী না ভেবে যে লোক ভেল্কিবাজীর যন্ত্র, যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিক এবং রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে শুধু ভাবে তার শিক্ষা দান করা উচিত নয়। সমস্ত সামাজিক প্রশ্নে এবং সর্বোপরি শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই জ্ঞানের সূচনা।
১৫. মনোবিজ্ঞান এবং রাজনীতি
রাজনীতিতে মনোবিজ্ঞান অনতিবিলম্বে যে সকল প্রতিক্রিয়ার কারণ হতে পারে, অথবা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাই আলোচনা করব। সম্ভাব্য ভালো এবং খারাপ দু’রকমের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমি আলোচনা করতে চাই।
রাজনৈতিক মতবাদ যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। সোনার মান প্রত্যাহার করার মতো। যান্ত্রিক একটি বিষয়ও প্রধানতঃ ভাবাবেগ দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। মনোঃসমীক্ষকদের মতে ভাবাবেগ হলো তেমন চিজ, যা সভ্যসমাজে কোন পাত্তা পায় না। এখন একজন যুবকের ভাবাবেগ বলতে শিক্ষার প্রতিভাসে সংমিশ্রিত প্রবৃত্তির সারাংশের . সুবৃহৎ পরিধিকেই বোঝায়। ভাবাবেগের এক অংশে শিক্ষাকল্পনার ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। প্রত্যেকে নিজেকে একজন সুন্দর মানুষ হিসেবে দেখতে চায় এবং যেটা তার কীর্তিস্থাপনের সম্ভাব্য সহজ পথ বলে মনে করে, সে পথেই তার কল্পনা এবং ধাবিত হয়। আমার মনে হয়, যদি কেউ যৌবনে মনোবিজ্ঞান পড়ে থাকে, তাহলে তিনি পরলোকগত লর্ড কার্জন অথবা লণ্ডনের প্রধান ধর্মাধ্যক্ষের মতো হতে পারবেন।
যে কোন বিজ্ঞানের দু’রকমের প্রতিক্রিয়া আছে। একদিকে বিশেষজ্ঞরা যা তৈরি এবং আবিষ্কার করেন যা শক্তির অধিকারী তারা তা ব্যবহার করেন। অন্যদিকে বিজ্ঞান আমাদের কল্পনায় প্রভাব বিস্তার করে আমাদের বোধবুদ্ধি এবং প্রত্যাশার পরিবর্তন সাধন করতে পারে। খুব কড়াকড়িভাবে বলতে গেলে তৃতীয় রকমের আরেকটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে তা হলো যাবতীয় ফলাফলসমূহ জীবনের পদ্ধতিতে একটা বিরাট পরিবর্তন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই তিন রকমের প্রতিক্রিয়াই এখন সুবিকশিত হয়ে ওঠেছে। প্রথম প্রতিক্রিয়াকে উড়োজাহাজের সাহায্যে দ্বিতীয়টাকে জীবনের প্রতি যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ এবং তৃতীয়টা হলো অধিকাংশ মানুষ শিল্প এবং শহরতলী অথবা গ্রামের মধ্যে পরবর্তী পছন্দের ওপর নির্ভর করে। মনোবিজ্ঞানে আমাদেরকে এখনো বিভিন্ন প্রকারের প্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি বুঝতে হলে ভবিষ্যৎবাণীর ওপর নির্ভর করতে হয়। ভবিষ্যৎবাণী সকল সময়ে ভীড় করে থাকে। প্রথম ধরনের প্রতিক্রিয়া তৃতীয় ধরনের প্রতিক্রিয়া যা আমাদের কল্পনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল তার চেয়ে ভবিষ্যত্বাণীর ওপর অধিকতর নির্ভরশীল। সুতরাং আমি প্রথমে প্রথম কারণের প্রধান প্রতিক্রিয়াগুলোর ওপর আলোচনা করব।
ইতিহাসের অন্যান্য সময়ের সম্বন্ধে কিছু বললে আবহাওয়াটা বুঝবার পক্ষে কিছু সাহায্য হতে পারে। মধ্যযুগে প্রত্যেকটা রাজনৈতিক প্রশ্নকে ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তির আলোকে বিচার করা হতো, যা সামঞ্জস্য বিধানের রূপ পরিগ্রহ করত। পোপ এবং সম্রাটের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। পোপ সূর্য এবং সম্রাট চন্দ্র বলে স্বীকৃত হলেন। শেষপর্যন্ত জয় হলো পোপের। পোপের সুশিক্ষিত সৈন্য ছিল বলে জয়লাভ করেছেন, একথা বললে ভুল করা হবে। তিনি তার সৈন্যদেরকে আকর্ষণীয় শক্তি সূর্য চন্দ্রের সামঞ্জস্যের তাৎপর্য বুঝিয়ে দিলেন। ফ্রান্সিসের মতাবলম্বীদেরকে তিনি সৈন্য হিসেবে সংগ্রহ করে মোতায়েন করলেন। এভাবেই জনতাকে মুগ্ধ করে সত্যিকারভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা হলো। আজকের যুগে কেউ কেউ সমাজকে যন্ত্র এবং কেউ কেউ গাছ বলে মনে করে। প্রথম দলের মধ্যে আছে ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যবাদী, শিল্পবাদী এবং বলশেভিক মতানুসারীরা এবং শান্তিবাদী, নিয়মতান্ত্রিকতাবাদী আর কৃষিভিত্তিক সমাজবাদীরা হলেন পরবর্তী দলের অন্তর্ভুক্ত। আদতে সমাজ যন্ত্র কিংবা গাছ দু’টোর কোনটা নয় বলে এ যুক্তিকে উদ্ভট মনে হয়।