এ সত্যবাদিতার মধ্যে যে পার্থক্য এক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ আমাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সত্য বলতে দেবতাদের ধারণাকে বোঝায়, যা আমরা অনুমান করতে পারি, কিন্তু অতো উঁচু লক্ষ্যে পৌঁছুবার আশা রাখতে পারিনে। আমাদের শিক্ষা এমন হওয়া চাই, যাতে করে আমরা সত্যের কাছাকাছি উপনীত হতে পারি এবং তার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই সত্যবাদিতা শিক্ষা করতে হবে। প্রমাণপঞ্জীর ওপর নির্ভর করে আমাদের মতামত গঠন করা এবং যতদূর প্রমাণিত হয় ততদূর বিশ্বাস করাকেই আমি সত্যবাদিতা মনে করি! এই সম্ভাবনার পরিমাণ নিশ্চিত সত্যের স্বরূপ নির্ধারণে যে সবসময় ব্যর্থ হবে, সেকারণে পুরণো বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আমাদেরকে নতুন প্রমাণকে গ্রহণ করার জন্য সবসময় তৈরি থাকতে হবে। অধিকন্তু, যখন কোন বিশ্বাস অনুসারে কাজ করি তখনই তা আমরা অত্যন্ত সম্ভব বলে মনে করি, কিন্তু নিজেদের বিশ্বাস ভুল কি নির্ভুল সে সম্বন্ধে চিন্তা করি না। বিশ্বাস যদি পাকাঁপোক্ত হয় তাহলে আমাদের উচিত বর্বরোচিত কাজসমূহ এড়িয়ে যাওয়া। বিজ্ঞানের একজন পর্যবেক্ষক তার পর্যবেক্ষন ফল সম্ভাব্য ভ্রান্তি সহকারে বর্ণনা করেন, কিন্তু একজন রাজনৈতিক অথবা একজন ধর্মতত্ত্ববিদ তার মতবাদের সম্ভাব্য ভ্রান্তির কথা বলেছে-কখনো কেউ তা শুনেছে কি? এর কারণ হলো বিজ্ঞানে আমরা সত্যিকার জ্ঞানের কাছাকাছি পৌঁছাই, সে-কারণে একজন মানুষ নিরাপদে বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করতে পারে, কিন্তু যেখানে কিছুই জানা হয়নি সেখানে ভোঁতা অনুমান এবং ইন্দ্রজাল অপরকে আমাদের বিশ্বাসে দীক্ষিত করার পরিচিতি পদ্ধতি। যদি ভিত্তি চিন্তার মধ্যে বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে ভালো যুক্তি থাকে তাহলে তারা তা শিক্ষা করা বেআইনী ঘোষণা করত না।
কাউকে রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং নৈতিক গোঁড়ামি শিক্ষা দেয়ার অভ্যাস করালে সব রকমের অশুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। এ-সম্পর্কে বলতে গেলে যে সকল পেশাদার শিক্ষক সততা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ প্রচেষ্টার সহযোগে শিক্ষাদান করে তা এসকল দোষ থেকে মুক্ত এবং তাদের প্রচেষ্টা ছাত্রদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নৈতিক এবং মানসিক পরিবর্তনের সূচনা করে। আমি তিনটা উদাহরণের সাহায্যে তা বুঝিয়ে তাদের দিচ্ছি। প্রথমতঃ রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের আলোচনা আমেরিকার একজন অর্থনীতির অধ্যাপক যারা অতিরিক্ত ধনী তাদের আরো ধন বৃদ্ধি করার মতবাদ শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন, যদি তাকে তা করতে না দেয়া হয় তাহলে তিনি হার্ভাডের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং বর্তমানে লণ্ডনের অর্থনীতির স্কুলের খ্যাতনামা শিক্ষক মি. লাস্কির মতো যেখানে সুবিধা পাবেন সেখানে গিয়েই তার মত প্রচার করবেন। আমাদের দ্বিতীয় আলোচনা ধর্মপ্রসঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে যারা প্রখ্যাত তাদের অনেকেই খ্রিষ্টধর্মে অবিশ্বাস করেন, কিন্তু তারা তা জনসাধারণের কাছ থেকে গোপন রাখেন, কেননা তা করলে তাদের আয় কমে যাবে। সুতরাং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়ে যাদের মতামত খুবই মূল্যবান তাদেরকে নিশ্ৰুপ থাকার দণ্ড ভোগ করতে হয়। আমাদের তৃতীয় আলোচনা নৈতিকতা প্রসঙ্গে। বাস্তবে সব মানুষ তাদের জীবন সম্পর্কে পবিত্র ধারণা পোষণ করে না। যারা পরিষ্কারভাবে গোপন করে রাখে তারা যারা গোপন করেনা তাদের চেয়ে অধম, যেহেতু এ প্রসঙ্গে কপটতার সঙ্গে অপরাধকে যুক্ত করে। কপট ব্যক্তিদের জন্যই শিক্ষকের চাকুরির পথ খোলা। শিক্ষকের পছন্দ এবং চরিত্রের গোঁড়ামির এত ব্যাপক প্রভাব।
ছাত্রদের ওপর কিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় এর ফলে, সে-সম্পর্কে আলোচনা করছি যা আমি নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক এ দু’পর্যায়ে বিভক্ত করে নেব। মতামতের মধ্যে কোনটাকে গ্রহণ করা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তরুণের কাছে প্রেরণাদায়ী; তাহলে দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে একজন তরুণ অর্থনীতি পড়ছে, সে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদী, সমাজতন্ত্রবাদী, রক্ষণশীল, স্বাধীন বাণিজ্যবাদী, মুদ্রাস্ফীতিবাদী সকলের মধ্যে বিশ্বাসীদের মত করে বক্তৃতা শুনবে। বিভিন্ন পদ্ধতির ওপর গ্রন্থগুলোর মতামতে বিশ্বাসীদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে পড়তে উৎসাহিত করা উচিত। তাহলে যুক্তির প্রমাণ যাচাই করতে শিখবে; কোন মতামত যে সম্পূর্ণ সত্য নয় তা জানতে পারবে, পূর্বনির্ধারিত বিশ্বাসে স্বীকৃতি না-দিয়ে সে মানুষকে গুণগত উৎকর্ষের জন্য বিচার করতে শিখবে। ইতিহাসকে শুধু নিজদেশের নয় বিদেশের দৃষ্টিভঙ্গিতেও শিক্ষা দেয়া উচিত। ইংল্যাণ্ডে যদি ফরাসিরা, ফ্রান্সে যদি ইংরেজরা ইতিহাস শিক্ষা দেয় তাহলে দু’দেশের মধ্যে তেমন কোন মতবিরোধ থাকবেনা, কারণ একে অন্যের দৃষ্টিকোণ বুঝতে সক্ষম হবে। এজন্য তরুণের সব প্রশ্নের অবারিত চিন্তা করতে শিক্ষা করা উচিত, যেখানেই নিয়ে যাক না যুক্তির ধাবমানতা ক্ষুণ করা উচিত নয়। জীবিকার্জন শুরু হলে বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদে তার এ আগ্রহ মরে যাবে, কিন্তু তার পূর্বপর্যন্ত তাকে স্বাধীন কল্পনা করার আনন্দ অনুভব করতে উৎসাহিত করা উচিত। তরুণদেরকে গোঁড়ামি শিক্ষা দেয়া নৈতিক দিক দিয়েও অত্যন্ত ক্ষতিজনক, তার ফলে সমর্থ শিক্ষকরা কপট হয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনা শুধু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দোষ হলো জান্তব প্রবৃত্তির আকারে সহনশীলতাকে বিনষ্ট করতে উৎসাহিত করে। এডমাণ্ড গোজ তার পিতাপুত্র গ্রন্থে বর্ণনা করেছে, তার বাবা আবার বিয়ে করতে যাবার সময় তাকে বলেছিলেন তার শৈশবাবস্থার কথা। বালক এডমাণ্ড দেখলেন যে তার মধ্যে এমন কিছু আছে লজ্জার কারণে তার বাবা মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তাহলে কি তিনি (Paedo Baptist) তার আগে পর্যন্ত তিনি তাদেরকে মন্দ লোক বলে মনে করে আসছিলেন। সুতরাং ক্যাথলিক স্কুলের ছাত্রেরা বিশ্বাস করে প্রোটেষ্টান্টরা খারাপ, যে কোন ইংরেজি ভাষাভাষী দেশের স্কুলের ছাত্রেরা বিশ্বাস করে ফরাসিরা খারাপ, ফরাসিদেশের ছেলেরা বিশ্বাস করে জার্মানেরা খারাপ এবং জার্মানির ছেলেরা ফরাসিদেরকে খারাপ মনে করে। বুদ্ধিবৃত্তিসম্মত পদ্ধতিতে নির্ভযোগ্য নয় এমন সব মতামতকে শিক্ষা দেয়ার আংশিক দায়িত্ব যখন স্কুল গ্রহণ করে, তখন তা বিরুদ্ধবাদীদের সম্বন্ধে খারাপ ধারণা জন্মিয়ে দিতে বাধ্য হয়। (বাস্তবে অধিকাংশ স্কুল তা করে থাকে) তা না হলে বিবেচনাশক্তিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ভাবাবেগ জাগাতে পারেনা। গোঁড়ামির কারণেই শিশুরা কৃপণ, নির্মম এবং কলহপরায়ণ হিসেবে গড়ে ওঠে। যে পর্যন্ত ধর্ম, নৈতিকতা এবং রাজনীতির নির্দিষ্ট মতামতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যাবেনা, তখন পর্যন্ত এর থেকে মুক্তিলাভের কোন পথ নেই।