অধিকাংশ শিশুর ক্ষেত্রে এটা সত্য যে এমনিতে ছেড়ে দিলে তারা লিখতে পড়তে শিখবে না, পরিবেশের সঙ্গে জীবনকে খাপ খাইয়ে নেয়ার মত করে গড়ে উঠবে না। সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অপরিহার্য এবং শিশুদেরকেও নিশ্চিতভাবে কিছু পরিমাণ শাসনের আওতায় রাখতে হবে। কোনরকমে শাসনকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করা যায় না বলে যত কম সম্ভব শাসন করে, কচিকাঁচার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, আকাঙ্খকে শিক্ষার লক্ষ্যে ধাবিত করবার দিকে আমাদের নজর দেয়া উচিত। অনেক সময় যেমন চিন্তা করা হয় তার চেয়ে এ অনেক সহজ পন্থা, কারণ জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক শিশুর স্বাভাবিক আকাঙ্খ। গরিব ছেলেরা যে পণিরের প্রতি আগ্রহ দেখাতে পারবে না তাতে একরকম সত্য কথা এবং শুদ্ধভাবে যে অঙ্ক কষতে পারবে তারও কোন ভরসা নেই। বিশেষ সাইজের একটা বাক্সের দরকার হলে তাকে যদি বৃত্তির পয়সা, জমিয়ে কাঠ এবং পেরেক কেনার কথা বলা হয়, তাহলে তা তার পাটিগণিতের শক্তি বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি করবে।
একটা শিশুকে যখন অঙ্ক কষতে বলা হবে তাতে কোন কিছু অনুমানমূলক থাকা উচিত নয়। একটি ছেলে অঙ্কের পাঠ সম্পর্কে একদা যে বক্তব্য করেছিল তা আমার মনে পড়ে। অভিভাবিকা (গভর্নের্স) তাকে প্রশ্ন দিয়েছিল, একটি ঘোড়ার দাম একটি টাটু গোড়ার তিনগুণ, টাটু ঘোড়ার দাম ২২ পাউণ্ড, ঘোড়ার দাম কত? বালকটি জিজ্ঞেস করল ‘টাটুর দাম কি নীচে ছিল? অভিভাবিকা জবাব দিলো, “তাতে কোন বেশকম হবে না। কিন্তু সহিস বলে তাতে অনেক বেশকম। অনুমানমূলক সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করা সাম্প্রতিক ন্যায়শাস্ত্রীয় বিকাশের একটি দিক শিশুরা তা বুঝতে পারবে এমন আশা করা উচিত নয়। সে যাহোক আমার বক্তব্য বিষয় থেকে একটু দূরে সরে এসেছি।
সব শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রহ উপযুক্ত উদ্দীপনার সাহায্যে জাগানো যায় আমি তা মনে করি না। কিছুসংখ্যক শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি গড়পড়তা বুদ্ধিরও অনেক নীচে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রয়োজন। বিভিন্ন মানসিক ক্ষমতা সম্পন্ন শিশুদের একশ্রেণীতে মেশানো উচিত নয়। তা করলে বুদ্ধিমান শিশুরা পরিষ্কারভাবে যা বুঝেছে তা বারবার বুঝবার জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়বে এবং বোকা শিশু এখনো বুঝতে পারে নি ভেবে নিশ্চিত দুঃখিত হবে। কিন্তু বিষয়বস্তুকে ছাত্রদের বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে ধাতস্থ করে তুলতে হবে। ম্যাকলেকে কেমব্রিজে অঙ্ক শিখতে হয়েছিল, কিন্তু অঙ্ক শেখা যে শুধু সময়ের অপচয় করা তা তার পত্রাবলী থেকে স্পষ্ট জানা যায়। আমাকে গ্রিক এবং ল্যাটিন শিখতে বাধ্য করা হয়েছিল, যে ভাষাতে কথাবার্তা বলা হয় না সে ভাষা শেখা হাস্যকর বলে আমি তা বর্জন করেছিলাম। নিতান্ত প্রয়োজনীয় বিষয় শিক্ষা দেয়ার পর শিশুদের রুচির সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার এবং শিশুর যাতে আগ্রহ একমাত্র তাই বাড়তে দেয়া উচিত। এতে শিক্ষকদের পরিশ্রম বাড়ে, কেননা বেশি কাজ করলে খুব সহজে ভোতা হয়ে যায়।
ঐতিহ্যাশ্রয়ী পাণ্ডিত্যাভিমানী ব্যক্তি যাদের জ্ঞান বিতরণশীল অথচ যারা জ্ঞান বিতরণ করবার কলা-কৌশল জানেনা, নিজেদের দোষ বুঝতে সক্ষম হয়ে কল্পনা করে কোমলমতি শিশুর শিক্ষার প্রতি স্বভাবতঃই তারা প্রচণ্ড বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। একজন মানুষ একটি বিড়াল ছানাকে ইঁদুর ধরতে শিক্ষা দেয়ার ওপর শেখভের একটি সুন্দর গল্প আছে। বিড়ালছানাটা পেছনে দৌড় দিতো না বলে ভয়ানকভাবে মার দিতো। এর ফল দাঁড়ালো বিড়ালটি বড়ো হলে পর ইউঁর দেখে ভয় পেতে লাগলো। শেখভ আরো বলেছেন সেই লোকটিই আমাকে ল্যাটিন শিখিয়েছিল। বিড়াল তার ছানাকে ইঁদুর ধরতে শেখায় কিন্তু ছানার নিজস্ব প্রকৃতি না-জাগা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। বিড়ালছানারা পরে তাদের ইঁদুর ধরার জ্ঞান অর্জন করার ব্যাপারে তাদের মার সঙ্গে একমত হয় বলে কোন শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজন পড়ে না।
জীবনের প্রথম দু অথবা তিনবছর শিক্ষাভিমানী ব্যক্তিদের আইনকে এড়িয়ে যেতে দেবে। বিশেষজ্ঞরা একমত যে ঐ সকল বছরেই আমরা জীবনের সবচেয়ে বেশি জ্ঞান আহরণ করি। প্রত্যেক শিশু নিজের চেষ্টায় কথা বলতে শেখে। কেউ নজর করলে দেখতে পাবে যে শিশুদের কথা বলা আয়ত্ব করতে যে-পরিমাণ চেষ্টা করতে হয় তা সামান্য নয়। শিশু মনোযোগ সহকারে শুনে ঠোঁট সঞ্চালন লক্ষ্য করে, সারাদিন ধ্বনি রপ্ত করার কাজে কাটায়, এ আনন্দিত পরিশ্রমে মনকে কেন্দ্রীভূত করে রাখে। অবশ্য বয়স্ক লোকেরা প্রশংসা করে তার উৎসাহ বৃদ্ধি করে। নতুন পৃথিবী সম্পর্কে ঔৎসুক্য জাগার আগে তাদেরকে তা জানার জন্য শাস্তি দিলে বিপরীত ফল ফলতো। বয়স্ক লোকেরা শিশুদের শুধু প্রশংসা এবং সুযোগ করে দেয়। জীবনের কোন পর্যায়ে এর চেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন আদৌ আছে কিনা তা রীতিমত সন্দেহজনক।
শিক্ষার জন্য যা প্রয়োজন তা হলো শিশু এবং কোমলমতি তরুণদের জ্ঞান অর্জন করা উচিত-এসত্যটা অনুভব করিয়ে দেয়া! অনেক জ্ঞান অর্জন করা বাঞ্ছনীয় নয় বলে এ-কাজ ভয়ঙ্কর অসুবিধা হয়ে পড়ে। কোন বিষয়ে সামান্য পরিমাণ জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা শিশুদেরকে প্রথমে বিরক্ত করে তুলবে এবং নানা অসুবিধার সৃষ্টি হবে তাদের মধ্যে অনুভব ক্রিয়া জাগাতে! যাহোক এসব অসুবিধা অনতিক্রমনীয় নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ অঙ্ক শিক্ষার কথা ধরা যেতে পারে। স্যানডারসন আইনড়ল দেখালেন যে তার ছেলে প্রায় সকলেই যন্ত্রপাতি তৈরি করার সম্বন্ধে উৎসাহী। তিনি তাদেরকে অবাধে যন্ত্রপাতি তৈরি করার সুযোগ দিলেন। বাস্তবে যন্ত্রপাতি নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে তারা অঙ্কের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারল এবং যে কাজে তাদের তীক্ষ্ণ আগ্রহ, গঠনমূলক সাফল্যের জন্য অঙ্কের প্রয়োজন, সুতরাং তারা অঙ্ক শেখায় মনোযোগী হয়ে পড়ল। এটা ব্যয়বহুল পদ্ধতি এবং শিক্ষকের প্রচুর ধৈর্য এবং দক্ষতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যদি ছাত্রদের প্রকৃতিতে আবেদন জাগাতে পারে তাহলে অতিরিক্ত মানসিক প্রচেষ্টা তাদের বিরক্তিকে অনেকাংশে লাঘব করতে সক্ষম হবে। মানুষ এবং প্রাণী উভয়েই স্বাভাবিকভাবে চেষ্টা করে। প্রবৃত্তিগত অনুরাগ সৃষ্টি করার মত চেষ্টা হওয়া চাই। পায়ে কলের চাকা ঘোরানোর চাইতে ফুটবল ম্যাচে অধিকতর প্রচেষ্টার প্রয়োজন, তবু তার একটা শাস্তি এবং অন্যটা আনন্দবিশেষ। মানসিক প্রচেষ্টা যে আনন্দদায়ক করে তোলার জন্য বিশেষ বিশেষ অবস্থার প্রয়োজন। পরবর্তীকালে ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থায় এসকল অবস্থা সৃষ্টি করার কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি। এর মধ্যে প্রধান যেগুলো; প্রথমত কোন সমস্যার সমাধান প্রয়োজন, দ্বিতীয়তঃ সমস্যার সমাধান বের করবার আশাবাদী মনোভাব বজায় রাখা। ডেভিড কপার ফিল্ডকে যেভাবে পাটিগণিত শেখানো হয়েছিল সে পদ্ধতি পর্যালোচনা করে দেখুন।