এখন আমি পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করব। পিতামাতার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অনুসারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গীরও বিভিন্নতা ঘটে থাকে। গড়পড়তা মজুরের আকাঙ্খ গড়পড়তা অন্যান্য পেশার ভদ্রলোকের চাইতে ভিন্ন রকম। গড়পড়তা মজুর ঘরে ঝামেলা কমাবার জন্য তার ছেলেমেয়েকে যত শিগগির সম্ভব স্কুলে ভর্তি করে এবং শিগগির তাদেরকে বের করে এনে তাদের আয়ের দ্বারা লাভবান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। সম্প্রতি বৃটিশ সরকার শিক্ষাখাতে ব্যয় হ্রাস করার সিদ্ধান্ত করেছে, সে জন্যে প্রস্তাব করা হয়েছ শিশুদের ছ’বছরের আগে স্কুলে যাওয়া অনুচিত এবং তের বছরের পরে স্কুলে থাকতে বাধ্য করা উচিত নয়। এর প্রথম প্রস্তাবটি জনসাধারণের মধ্যে এত বেশি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সঞ্চার করেছে যে প্রস্তাবটিকে নাকচ করতে হয়েছে। জননীদের (সম্প্রতি ভোটাধিকার প্রাপ্ত) দুর্দমনীয় আক্রোশই প্রস্তাবটিকে নাকচ করাতে বাধ্য করেছে। পরবর্তী প্রস্তাব স্কুল ত্যাগ করবার বয়স কমানো জনসাধারণের মধ্যে কোন আপত্তির কারণ হয়ে দেখা দেয়নি। পার্লামেন্টের প্রার্থীদের সভায় যারা যোগদান করেন তারা তাদের উচ্চশিক্ষা সম্বন্ধে বক্তব্যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে কিন্তু অরাজনৈতিক দিনমজুরেরা (সংখ্যায় যারা গরিষ্ঠ) তাদের ছেলেমেয়েদেরকে যত শিগগির-সম্ভব স্কুল ছাড়িয়ে কাজে নিয়োগ করতে ইচ্ছুক। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তারা মহান ত্যাগ স্বীকার করতেও ইচ্ছুক, কিন্তু আমাদের প্রতিযোগিতামূলক সমাজ ব্যবস্থায়, যে শিক্ষা পদ্ধতি আপনার থেকে ভালো তার চেয়ে অন্য লোকের যে শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো গড়পড়তা পিতামাতা ছেলেমেয়েদেরকে সে ব্যবস্থানুসারে শিক্ষিত করে। লেখাপড়ার সাধারণ মানকে অবনমিত করে রাখার পক্ষেও এ পদ্ধতি হয়ত সুবিধাজনক, কিন্তু তাই বলে পেশাদার ব্যক্তিরা মজুরদের ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা সুযোগ সুবিধা দান করবে তা আমরা আশা করতে পারিনে। যারা ডাক্তারি শিক্ষা করতে ইচ্ছুক তাদের পিতামাতা যতই দরিদ্র হোকনা কেননা সকলেই যদি ডাক্তার হবার সুযোগ পায়, তাহলে এটা পরিস্কার যে ডাক্তারদের আয় বর্ধিত প্রতিযোগিতা এবং সমাজের মানুষের উন্নততর স্বাস্থ্যের কারণে বর্তমানের তুলনায় অনেক গুন কমে যেত। আইনব্যবসা সিভিল সার্ভিস সবক্ষেত্রে ঐ একই নীতি সমানভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং পেশাদার মানুষেরা নিজেদের সন্তানের বেলায় যা ভালো মনে করে, খুব ব্যতিক্রম জনদরদী না হলে, সাধারন মানুষের বেলায় তা ভালো মনে করেনা।
আমাদের প্রতিযোগী সমাজব্যবস্থায় বাবাদের মৌলিক দোষ হলো তারা চায় যে ছেলেরা তাদের গৌরব এবং কৃতিত্বের স্থল হোক। প্রবৃত্তির গভীরে এ দোষ শিকড়িত একমাত্র পৌনঃপুনিক প্রচেষ্টার ফলে তার নিরাময় হতে পারে। অল্প পরিমাণে হলেও এ দোষ থেকে মুক্ত নয় মায়েরা। আমরা প্রবৃত্তিগতভাবে আমাদের সন্তানের সাফল্যে গৌরব এবং ব্যর্থতায় লজ্জাবোধ করি। দুর্ভাগ্যবশতঃ সন্তানের যে সাফল্য আমাদেরকে অহংকারে স্ফীত করে তোলে তা অনেক সময়ই অবাঞ্চিত ধরণের হয়ে থাকে। সভ্যতার শৈশব হতে আজ পর্যন্ত চীন এবং জাপানে পিতামাতারা ধনী বর এবং বধু নির্বাচন করে, নিজেরা তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তানের সুখ-সন্তুষ্টি বলি দিয়ে থাকে পাশ্চাত্যদেশে (ফ্রান্সের অংশবিশেষ বাদে) সন্তানেরা বিদ্রোহ ঘোষনা করে তাদেরকে এ দাসত্ব থেকে মুক্ত করে নিয়েছে, কিন্তু তার ফলেও পিতামাতার প্রবৃত্তিতে তেমন বিশেষ পরিবর্তন আসেনি। সুখ কিংবা গুনপনা দুটোর কোনটাই নয়। গড়পড়তা পিতামাতা চায় তাদের সন্তান জাগতিক সাফল্যের অধিকারী হোক। তারা তা চায় একারণে যে এতে করে তারা সন্তান-সন্ততি আত্নীয় স্বজনদের জন্য গর্ব করতে পারে। মুখ্যতঃ এ-আকাঙ্ক্ষার তাগিদেই তারা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা করে থাকে, রাষ্ট্র গিজা, স্কুলশিক্ষক এবং পিতামাতা যাদের সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করছি, ক্ষমতার দ্বারা যদি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন হয় তাদের এক বা একাধিক মাধ্যমের ওপর অবশ্যই ক্ষমতা অর্পিত থাকতে হবে। আমরা দেখেছি, এদের কাউকে শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য পুরোপুরি ভাবে বিশ্বাস করা যায় না; যেহেতু প্রত্যেকে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে শিশুকে গড়ে তুলতে চায় তার সঙ্গে উন্নতির কোন সঙ্গতি নেই। রাষ্ট্র চায় শিশু জাতীয় প্রতি হিংসার জন্য আত্ননিয়োগ করুক এবং প্রচলিত সরকারকে সমর্থন করুক। প্রতিযোগী পৃথিবীতে রাষ্ট্র যেভাবে জাতিকে সম্মানের চেখে দেখে অধিকাংশ সময় স্কুলশিক্ষকরাও স্কুলকে তেমনি শ্রদ্ধান্বিত দৃষ্টিতে দেখে এবং চায় যে সন্তান পরিবারের গৌরব বৃদ্ধি করুক। শিশুর উন্নতি এবং সুখ বিকাশে সম্ভব,এবং আলাদা একজন মানুষ হিসেবে শিশুর নিজেই নিজের লক্ষ্য স্বরূপ, আংশিকভাবে ছাড়া বিভিন্ন বাহ্যিক উদ্দেশ্য তার নিজস্ব লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। জীবনকে পরিচালনা করার জন্যে যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, দুর্ভাগ্যবশতঃ শিশুর তা নেই। নির্দোষিতার সুযোগে তারা বিভিন্ন মন্দ উদ্দেশ্যের শিকার হয়ে পড়ে। এর ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় অসুবিধার সৃষ্টি হওয়ায় তা রাজনৈতিক সমস্যার আকার ধারণ করেছে। কিন্তু শিশুদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কি বলা যায়, প্রথমে তাই আমাদের দেখা উচিত।