এই ব্যবস্থা যখন একবার দৃঢ়ভাবে প্রবর্তন করা হলো তখন রাষ্ট্র বুঝতে পারলো একে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়। শিক্ষার সাহায্যে তরুণদেরকে ভালো এবং খারাপ দু’দিকেই সহজে বাকানো যায়। এর ফলে উন্নততর ভদ্রতার মান প্রতিষ্ঠিত হলে, অপরাধের সংখ্যা কমে গেলো জনসাধারণের জন্য মিলেমিশে কাজ করার সুযোগ দান করল এবং কেন্দ্রের আদেশ শুনবার জন্য সমাজকে অধিকতর আবেদনশীল করে তুলল। শিক্ষা ছাড়া নামেমাত্র গনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হতে পারে। রাজনৈতিকেরা গণতন্ত্র বলতে এমন একটি সরকার বুঝেন, যে পদ্ধতি অনুসারে জন সাধারন নেতাদেরকে তাদের আশা-আকাক্ষার নিয়ামক মনে করে, নেতাদের ইচ্ছানুসারে স্বেচ্ছায় পরিচালিত হয়। সেকারণে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নানা রকম পক্ষপাতমূলক উদ্দেশ্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এ পদ্ধতিতে তরুণদেরকে (যতদূর সম্ভব) প্রচলিত বিধিব্যবস্থাকে শ্রদ্ধা করতে শিক্ষাদান করে। ক্ষমতাসীন সরকারকে ভিত্তিগতভাবে সমালোচনা করার ইচ্ছাকে পরিহার এবং অন্যজাতি ও বিদেশীর সম্পর্কে ঘৃণা এবং সন্দেহ পোষন করার শিক্ষা দান করে। আন্তর্জাতিকতা এবং ব্যক্তিগত বিকাশের বদৌলতে এই ব্যবস্থা জাতীয় ঐক্য এবং সংহতির ভিত্তি সুদৃঢ় করে। ক্ষমতাসীনের অন্যায় চাপের ফলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের চরম ক্ষতি হয়। প্রচলিত বিশ্বাসের সঙ্গে যার বিশ্বাস খাপ খায়না তাকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়। শাসকদের কাছে সুবিধাজনক বলে তারা ঐক্যের ওপর জোর দান করে, যদিও একমাত্র মানসিক অবক্ষয় সাধন না করে তা হাসিল করা যায় না। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থায় ক্ষতির পরিমান এত অধিক যে সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা সামগ্রীকভাবে ভালো করেছে কি খারাপ করেছে সে ব্যাপারে শাণিত প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়।
শিক্ষাব্যবস্থায় গিজার যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা বাস্তবে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুব বেশী আলাদা নয়, সে যাহোক উভয়ের মধ্যে এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বর্তমান। গির্জার মতে যাজকদের শিক্ষিত হবার কোন প্রযোজন নেই, রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দেশিত হলে তাদেরকে শুধু বিশেষ নির্দেশ দিয়ে থাকে, স্বাধীন অনুসন্ধানে যে সকল বিশ্বাস অযৌক্তিক এবং অসার প্রমাণিত হবে, রাষ্ট্র এবং গির্জা সে-সকল বিশ্বাসের অনুপ্রবেশে আত্ননিয়োগ করে। রাষ্ট্র যারা সংবাদপত্র পড়তে পারে তাদেরকে অতি সহজে দীক্ষিত করে আর গির্জা অশিক্ষিতদেরকেই অনায়াসে দীক্ষিত করে। রাষ্ট্র এবং গিজা উভয়েই স্বাধীন চিন্তার পরিপন্থী। আবার গিজা যা এখন কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে তারা হয়ে থাকে যে কোন রকম পদ্ধতির প্রতিবন্ধক। যে পদ্ধতি অনুসারে সূদুর অতীতে জেসুইটেরা পথ অতিক্রম শুরু করেছিল সেই পদ্ধতিকে পরিপক্ক এবং পূর্নাঙ্গ বিবেচনা করে একদেশদর্শী ক্ষমতাসীনেরা বর্তমানে নির্দেশ দান করছে। এবং ভবিষ্যতেও করবে।
আধুনিক জগতে স্কুল শিক্ষকদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে বিচার করতে দেয়া হয় না। শিক্ষাবিভাগ কর্তৃক তিনি নিয়োজিত হয়েছেন এবং তিনি শিক্ষা দান করবেন, যদি তিনি আদেশ লজ্ঞান করেন তখন তাঁকে বরখাস্ত করা হবে। এই অর্থনৈতিক অভিপ্রায় ছাড়াও স্কুল শিক্ষক তিনি জানেন না এমন অনেক অবচেতন প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়ে পড়বেন। শৃঙ্খলা রক্ষা করার ব্যাপারে রাষ্ট্র এবং গির্জার চাইতে তাঁর পদক্ষেপ আরো সুস্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ। সরকারিভাবে তার ছাত্রেরা যা জানেনা, তিনি তা জানেন। কিছু পরিমান-শৃঙ্খলা এবং ক্ষমতা ছাড়া একটা ক্লাশকে সুষ্ঠুভাবে চালানো অসম্ভব। কোন বালক আগ্রহ দেখাবার বদলে বিরক্তি দেখালে তাকে শাস্তি দেয়া খুবই সহজ। অধিকন্তু, উত্তম স্কুলশিক্ষকও তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেন। তিনি ছাত্রদেরকে যে ধরণের মানুষ করে তুলতে চান, সে ছাঁচে তাদেরকে ঢালাই করবার ইচ্ছা পোষণ করেন। লিটন স্ট্রাচি বলছেন ড. আর্ণলড কোমো হ্রদের পাশে হাঁটবার সময় গভীরভাবে নৈতিক দোষ সম্পর্কে চিন্তা করছেন। তার মতে যে পরিবর্তন ছেলেদের মধ্যে ঘটাতে চান সেগুলোই হলো নৈতিক দোষ। যে-বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি এ-চিন্তা করেছেন তার মধ্যে ভালোবাসার চেয়ে ক্ষমতাপ্রীতি এই পরিচয় অধিক। এই দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে দেখা গিয়েছে। প্রতারণামূলক আত্মপ্রভাবের দিকে সন্ধানী দৃষ্টি রাখা শিক্ষকের উচিত নয়। এটা আশা করা স্বাভাবিক, তা সত্ত্বেও শিক্ষক যে শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জোরালো মাধ্যম এবং প্রাথমিকভাবে তার কাছে নিশ্চিতভাবে আমাদেরকে প্রগতিশীলতার প্রত্যাশা করতে হবে।
তা ছাড়া স্কুলশিক্ষক তার নিজস্ব স্কুলের কৃতিত্বের আশা করেন। তিনি তাঁর ছেলেদেরকে ক্রীড়াপ্রতিযোগিতা এবং বৃত্তিলাভের জন্য বিশিষ্ট করে তুলতে চান, যার ফলে তাকে সব ছেলের বদলে নির্বাচিত কয়েকটি ভালো ছেলের প্রতি বিশেষ যত্নবান হতে হয়। এতে বিভেদ এবং মর্যাদার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে বলে ফল দাঁড়ায় মারাত্মক। অন্যদেরকে ভালো খেলতে দেখার চাইতে নিজে অংশগ্রহণ করে খারাপ খেলা একজন বালকের পক্ষে অধিকতর মঙ্গলজনরক! মি. এইচ, জি ওয়েলস তার লাইফ অব সানডারসন অউনডেল গ্রন্থে দেখিয়েছেন এই মহান স্কুলশিক্ষকেরা কিভাবে মুখ ঘুরিয়ে বসে থেকে গড়পড়তা ছাত্রের মনোবৃত্তি অযত্নে অকর্ষিত রাখে। তিনি প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর দেখতে পেলেন যে একমাত্র নির্বাচিত ছেলেরাই গির্জায় গাইতে পারে এবং তাদেরকে ভজন গাইতে শিক্ষা দিয়ে বাকি সকলকে শ্রোতা হিসেবে রাখা হলো। স্যাণ্ডারসন জিদ করতে লাগলেন মধুর হোক না হোক সকলেরই ভজন গাওয়া উচিত। এতে তিনি এমন এক পক্ষপাতমূলক মনোভাবের বিরুদ্ধে মাথা তুলতে চাচ্ছেন যা একজন স্কুলশিক্ষকের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। যিনি তার ছেলেদের চাইতে নিজের কৃতিত্বের জন্য ঢের বেশি লালায়িত। অবশ্য যদি আমরা বিজ্ঞোচিতভাবে কৃতিত্বের বিচার করি, দু’উদ্দেশ্যের মধ্যে তেমন কোন বিরোধ দেখতে পাবোনা। যে স্কুলের ছেলেরা সবচেয়ে বেশি ভালো করেছে, সে স্কুলই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের দাবীদার। কিন্তু ব্যস্ত পৃথিবীতে দেখা যায় সাফল্য সবসমসয় বেশি প্রয়োজনের অনুপাতের ওপরই নির্ভরশীল। এতে করে দু’উদ্দেশ্যের মধ্যে সংঘাত এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।