উপসংহারে মনস্তাত্ত্বিক গতিবাদ যে শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম শুরুতে, সে সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে চাই। যে সমাজে একজাতীয় চরিত্রের মানুষ অধিক, সে সমাজ বিভিন্ন জাতীয় চরিত্রের সমবায়ে গঠিত সমাজ থেকে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। মানুষ এবং বাঘে মিলে যে সমাজ গঠিত সে সমাজে অধিক স্বাধীনতা থাকতে পারে না, মানুষকে অথবা বাঘকে অবশ্যই দাসত্বের শৃঙ্খল পরতে হবে। সুতরাং পৃথিবীর যে অঞ্চলের মানুষ কৃষ্ণকায়দের শাসন করে সেখানে কোন স্বাধীনতা থাকতে পারে না। অধিক পরিমাণ স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে, শিক্ষার সাহায্যে চরিত্র গঠনের প্রয়োজন, যাতে করে মানুষ যে সব কাজ নির্যাতনমূলক নয় তার মধ্যে সুখের সন্ধান করতে পারে। জীবনের প্রথম ছ’ বছরে চরিত্র গঠন যখন হয় তখনই এই শিক্ষা দিতে হয়। ডেপটফোর্ডে মিস ম্যাকমিলান ছেলেদেরকে যেভাবে শিক্ষা দিচ্ছেন, তার ফলে শিশুরা একটি স্বাধীন সম্প্রদায় গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর পদ্ধতি অনুসারে ধনী দরিদ্র সকলকে শিক্ষা দান করা যায়, তাহলে এক পুরুষকালে আমাদের সামাজিক সমস্যা সমাধান করার পক্ষে যথেষ্ট। শিক্ষার মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কি তার অবিচার না করে পদ্ধতির ওপর, জোর দেয়ার দিকে সকল পার্টি অন্ধ হয়ে উঠে-পড়ে লেগেছে। পরবর্তী বছরগুলোতে অনেক আকাঙ্ক্ষার মূলতঃ পরিবর্তন না করে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, সেজন্য শৈশবাবস্থায় বাচ এবং বাঁচতে দাও এ শিক্ষা শিশুদেরকে অবশ্যই দিতে হবে। যে সকল জিনিষ অন্যের ক্ষতি করা ছাড়া অর্জন করা যায় না; অনাগ্রহী নর-নারীকে সে সকল জিনিস দেয়া হোক। সামাজিক স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক দ্রুত অপসারিত হবে।
১৪. শিক্ষার প্রশ্নে স্বাধীনতা বনাম ক্ষমতা
অন্যান্য বিষয়ের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও স্বাধীনতা পরিমানগত। কোন কোন বিষয়ে স্বাধীনতাকে বরদাশত করা হয় না। একবার আমার সঙ্গে এক ভদ্রমহিলার দেখা হয়েছিল যিনি মনে করতেন, কোন বিষয়ই শিশুদেরকে বাধা দেয়া উচিত নয়, যেহেতু শিশুর অন্তর্নিহিত প্রকৃতি আপনা-আপনি বিকাশ লাভ করে। আমি তাঁকে। জিজ্ঞেস করেছিলাম যদি আলপিন ভক্ষণ করে তখন কেমন হবে। খুবই দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হচ্ছে ভদ্রমহিলা জবাবে আমাকে কেবল কটুক্তিই করেছিলেন। তা সত্ত্বেও শিশুদের ছেড়ে দেয়া হলে তাড়া শিগগির অথবা দেরিতে আলপিন ভক্ষণ করবে, ঔষদের বোতল থেকে বিষপান করবে, অথবা উচ্চ কোন জানালা থেকে। লাফিয়ে পড়বে, অথবা ও জাতীয় কোন অঘটন ঘটাবে। একটু বয়স বাড়লে পরে বালকেরা সুযোগ পেলেই অপরিষ্কার থাকবে, অতিরিক্ত খাবে, এবং রোগে না ধরা পর্যন্ত ধূমপান করবে, ঠাণ্ডার কাঁপুনি না ধরা পর্যন্ত ভেজা পায়ে কাটাবে আরো-কত কিছু করবে। বয়স্ক লোকেরা যাদের রসিকতা করার ক্ষমতা নেই, সাধারণতঃ তাদেরকে উৎপাত করার কারণেই তারা সে সব করে থাকে। সুতরাং যারা শিক্ষার মধ্যে স্বাধীনতা থাকাটা আবশ্যক মনে করেন, তারা এ-বলতে চান যে শিশুরা যা করতে পছন্দ করে, সারাদিন কেবল তাই করে কাটাবে। কিছু পরিমাণ শৃঙ্খলা এবং শাসন অবশ্যই থাকতে হবে। এখন কথা হলো, তার পরিমাণ এবং কিভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে তাই নিয়ে।
শিক্ষাকে রাষ্ট্র, গির্জা, স্কুলশিক্ষক, পিতামাতা (এমনকি যা সাধারণতঃ খেয়াল করেনা কেউ) শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকেও বিচার করা যেতে পারে। এ দৃষ্টিভঙ্গীসমূহের প্রত্যেকটিই খণ্ডিত, প্রত্যকটার মধ্যে অল্পবিস্তর শিক্ষার আদর্শ প্রতিফলিত হয়ে থাকে, আবার তাতে এমনও অনেক উপাদান আছে যা ক্ষতিকর। চলুন আমরা একটা একটা আলাদাভাবে পরীক্ষা করে দেখি এবং এর প্রত্যেকটার পক্ষে বিপক্ষে কি যুক্তি থাকতে পারে তা পর্যালোচনা করি।
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র শক্তিশালী রূপকার রাষ্ট্রকে নিয়েই আমরা আলোচনা শুরু করব। সাম্প্রতিক কালেই শিক্ষাব্যবস্থায় রাষ্ট্রের আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মধ্য যুগে, প্রাচীনকালে এ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না। রেনেসাঁর পূর্ববর্তী সময়ে কেবলমাত্র গির্জাই শিক্ষাব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ করত। সরোবন গির্জার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্যে রেনেসা কলেজ দ্যা ফ্রান্সের মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করে, উচ্চতর জ্ঞান আহরণের জন্য সযত্ন প্রয়াসের সঞ্চার করে। ইংল্যাণ্ড এবং জার্মানিতে রিফরমেশন আন্দোলনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যাকরণ শিক্ষার স্কুলসমূহে পোপের প্রভাব হ্রাস করার নিমিত্ত রাষ্ট্রকর্তৃক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খা জাগরিত হয়। কিন্তু এ আকাঙ্খ খুব শিগগিরই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সার্বজনীন বাধ্যতামূলক আধুনিক শিক্ষার আন্দোলন না-হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্র শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের কোন উল্লেখযোগ্য অথবা নিরবচ্ছিন ভূমিকা গ্রহণ করেনি। সে যাহোক এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ পরিচালনার ব্যাপারে অন্যান্য প্রভাবের সম্মিলিত ফলের চাইতে রাষ্ট্রের প্রভাব অধিকতর ব্যাপক এবং সূদুরপ্রসারী।
যে সমস্ত উদ্দেশ্যে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে তা বিভিন্ন রকম। এর শক্তিশালী সমর্থকেরা বিচলিত হয়ে ভেবেছিলেন, লিখতে পড়তে জানা প্রত্যেক মানুষের উচিত, অজ্ঞ জনসাধারণ সভ্য দেশের কলঙ্ক এবং শিক্ষা ব্যতীত গণতন্ত্র অচল। এ সকল উদ্দেশ্যের সঙ্গে অন্যান্য কারণ সংযোজিত হয়ে বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার দাবিকে আরো বেগবতী করে তুলেছে। পরে দেখা গেলো শিক্ষা বাণিজ্যিক সুবিধা দান করে, শিশু অপরাধ কমায় এবং শিক্ষাব্যবস্থা কদর্য অধিবাসীদের গণ্ডীবদ্ধ করে রাখতে সুযোগ দান করে। যাজক বিরোধীরা রাষ্ট্র পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে গির্জার প্রভাব ধ্বংস করার সুবিধা দেখতে পেলো। তুলনামূলকভাবে ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্সে এই প্রভাব অধিকতর সক্রিয় ছিল। বিশেষতঃ ফ্রাঙ্কো প্রাশান যুদ্ধের পরে জাতীয়তাবাদীরা মনে করল যে সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয় শক্তির বৃদ্ধি সাধন করবে। প্রারম্ভে এ সকল এবং আরো কারণ সমূহ গৌণ উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণের পেছনে যে উদ্দেশ্যটি ছিল প্রধান, তাহলো নিরক্ষরতার প্রতি অপমানজনক ধারণা।