উন্মাদসত্তাকে বাদ দিয়ে কবি এবং প্রেমিকসত্তাকে কি অটুট রাখা সম্ভবপর? আমাদের সকলের মধ্যে এ তিন সত্তা বিভিন্নভাবে বর্তমান। কিন্তু সেগুলো কি এতই অবিচ্ছিন্ন যে, একটাকে নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনলে অন্যটা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি তা বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি আমাদের মধ্যে কিছু শক্তি রয়েছে, যা বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে অনুপ্রাণিত নয়-এমন সব কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেতে পারে। অবস্থাভেদে শিল্পকলা আবেগময় ভালোবাসাও আবেগময় ঘৃণার মধ্যে তার প্রকাশ ঘটাতে পারে। পরস্পরা নিয়মানুবর্তিতা এবং সময়সূচি হলো আধুনিক শিল্পব্যবস্থার লৌহশৃঙ্খল, যা আমাদের ভালোবাসাকে অকেজো করে ফেলেছে, যাতে করে তা সৃজনশীল এবং প্রধান না হয়ে একদেশদর্শী হয়ে উঠেছে। যে জিনিশ সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন এবং মুক্ত হওয়া উচিত ছিল, তার উপর বিধি-নিষেধের আরোপ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সমস্ত যাজকদের আশীর্বাদের এত হিংসা-দ্বেষ ঘৃণা এবং অত্যাচারকে মুক্ত করা হয়েছে। আমাদের প্রবৃত্তিগত প্রক্রিয়ার দুটি অংশ। একটি আমাদের জীবনকে আমাদের বংশধরের মধ্যে দীর্ঘতর করে, অন্যটি আমাদের কল্পিত শত্রুদের জীবনকে ধ্বংস করতে চায়। প্রথমটির মধ্যে আছে জীবনের আনন্দ ভালোবাসা এবং শিল্পচেতনা, যা আমাদের ভালোবাসার মনস্তাত্ত্বিক প্রকাশ। দ্বিতীয়টির মধ্যে আছে প্রতিযোগিতা দেশপ্রেম এবং যুদ্ধ। প্রচলিত নৈতিকতা প্রথমটাকে অবদমন করে দ্বিতীয় প্রবৃত্তিকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু সত্যিকারের নৈতিকতার ক্রিয়া হবে এর বিপরীত। আমরা যাদেরকে ভালোবাসি তাদের সঙ্গে আমরা প্রবৃত্তিগতভাবে আচরণ করতে পারি এবং যাদেরকে ঘৃণা করি তাদের বেলায় আমাদের যুক্তিসম্মত আচরণ করা উচিত। আধুনিক বিশ্বে যাদেরকে আমরা সক্রিয়ভাবে ঘৃণা করি তারা হলো দূরবর্তী মানুষ, বিশেষ করে বলতে গেলে বিদেশী জাতিসমূহ। আমরা তাদের সম্বন্ধে বিমূর্তভাবে ধারণা পোষণ করি এবং যেসব কাজ ঘৃণ্য এবং জঘণ্য সেগুলোর বিচারে প্রেম অথবা তেমন উচ্চাদর্শের বশবর্তী হয়ে তাদের ক্ষতি করে নিজেদেরকে প্রতারিত করি। একমাত্র অধিকমাত্রায় সংশংয়বাদই, যে-আবরণের অন্তরালে সত্য লুকিয়ে থাকে তা দূরীভূত করে আমাদের চোখে সত্যকে জাজ্বল্যমান করে তুলতে পারে। তাতে সফলতা অর্জন করতে পারলে আমরা নতুন নৈতিকতার জন্ম দিতে পারব, যার ভিত্তি প্রতিবন্ধকতা এবং হিংসার মধ্যে প্রোথিত নয়, বরং তা সম্পূর্ণ জীবনের আকাক্ষার রূপায়নে দেদীপ্যমান। হিংসার রোগ থেকে আরোগ্যলাভ করলে মানুষকে তার পথের বাধা মনে না করে সহায়ই মনে করবে। এটা কোন কাল্পনিক আকাক্ষা নয়, রাণী প্রথম এলিজাবেথের যুগে অংশতঃ এর বাস্তবায়ন হয়েছিল ইংল্যাণ্ডে এবং যদি মানুষ অন্যের ক্ষতি না করে নিজের আনন্দ খুঁজে নিতে পারে তাহলে আগামীকাল তার বাস্তবায়ন সম্ভব। এটা, আয়ত্ব করা অসম্ভব-এমন কোন নৈতিকতা নয়। কিন্তু তা গৃহীত হলে আমাদের পৃথিবীর স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে।
০২. স্বপ্ন এবং বাস্তব
আমাদের বিশ্বাসসমূহে আমাদের আকাঙ্ক্ষার প্রভাব যদিও সধারণ জ্ঞান এবং পর্যবেক্ষণের বিষয়, তবু এ সকল বিশ্বাসের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করতে গিয়ে বিস্তর ভুল ধারণা পোষণ করা হয়েছে। রীতিগতভাবে আমরা ধরে নিই যে আমাদের বেশির ভাগ বিশ্বাসের পেছনে সত্যের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে, যদিও আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো সাময়িক বিরোধসৃষ্টিকারী শক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু সোজাসুজি বিপরীত বিন্দুর কাছাকাছি কোথাও আসল সত্যের অবস্থিতি। যে সব বিশ্বাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন, তাতে অনেক আকাক্ষা বিম্বিত হয়ে ওঠে, আবার সে আকাক্ষা সমূহই এখানে-সেখানে রূঢ় বাস্তবের কঠিন আঘাতে পরিশুদ্ধি লাভ করে। আদতে মানুষ স্বাপ্নিক, তবে বাইরের পৃথিবীর বিচিত্র সংঘাতে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে, কিন্তু খুব শিগগীরই আবার কল্পনার সুখের জগতে স্বেচ্ছায় ঝাঁপ দেয়। ফ্রয়েড দেখিয়েছেন স্বপ্নের চিত্রায়নের মধ্যে আমাদের অপূর্ণ কামনারা পরিতৃপ্তি লাভ করে। দিবাস্বপ্ন সম্বন্ধেও তার কথা একইভাবে সত্য। তার উপসংহারে তিনি যেগুলোকে দিবাস্বপ্ন বলে আখ্যায়িত করেছেন, সেগুলোকে আমরা বিশ্বাস বলে ধরে নিতে পারি।
তিনটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আমাদের মনের অচেতন স্তরের অন্বিষ্ট বিশ্বাসের বিশ্লেষণ সম্ভব। মনঃসমীক্ষণ (Psycho analysis) মনের উন্মাদ হিষ্টিরিয়াগ্রস্ত জটিল পরিস্থিতি বিশ্লেষেণ করে মনের ধ্রুব প্রকৃতির দিক দিয়ে সুস্থ ও রোগাক্রান্ত ব্যক্তির তফাৎ কত স্বল্প তাই দেখানো হয়। (Sceptical) সংশয়াত্মক পদ্ধতিতে দার্শনিকেরা আমাদের অন্তরলালিত বিশ্বাসসমূহের প্রমাণপঞ্জী যে কত দুর্বল তাই স্পষ্ট করে তোলেন। সর্বশেষ হলো সাধারণ পর্যবেক্ষণ (common observation) পদ্ধতি। এই সর্বশেষ পদ্ধতিটিই আমার বিবেচ্য বিষয় হিসেবে ধরে নিচ্ছি।
নৃতত্ত্ববিদদের পরিশ্রমের কল্যাণে আমরা সভ্যতার সৌরভবর্জিত আদিম অসভ্যদের সম্বন্ধেও জানতে পেরেছি। তারাও সজ্ঞানে অজ্ঞানতার অন্ধকারে বিচরণ করে না একথা সত্য; কিন্তু কোন কিছু সুস্পষ্টভাবে বুঝে ওঠার মতো তেমন প্রখরও নয় তাদের চেতনা। পক্ষান্তরে তাদের কাছে অসংখ্য সংস্কার, যা চেতনার গভীরে এত সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত যে জীবনের প্রায় সব প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত করে সে অন্ধবিশ্বাস। তাদের অনেকেরই ধারণা, কোন প্রাণী কিংবা যোদ্ধার মাংসভক্ষণ করলে ঐ প্রাণী বা যোদ্ধা জীবদ্দশায় যে-সকল গুণের অধিকারী ছিল তা আয়ত্ব করা যায়। আবার অনেকে দলপতির নাম মুখে আনাকে মৃত্যুদণ্ডনীয় পবিত্রতা হানিকর কাজ বলে মনে করত। এমনকি তারা রাজা বা দলপতির নামের কোন অংশের সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাম উচ্চারণ করবার বেলায় ঐ অংশটির পরিবর্তন করে ফেলত। যেমন তাদের রাজার নাম জন, সুতরাং তারা জনকুইলকে উচ্চারণ করবে জর্জ কুইল ইত্যাদি ইত্যাদি। কৃষিভিত্তিক সমাজে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে যখন তাদের খাদ্যের জন্য আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করতে হলো অত্যধিক পরিমাণে, তখন থেকে মন্ত্রোচ্চারণ এবং হোমাগ্নি জ্বালিয়ে রোদবৃষ্টির সঞ্চার করা যায় বলে তারা বিশ্বাস করতে থাকে। তারা আরো বিশ্বাস করত খুনী ব্যক্তির প্রেতাত্মা প্রতিশোধস্পৃহায় হত্যাকারিকে খুঁজে বেড়ায়। আবার অতি সহজ ছদ্মবেশে যেমন মুখ রাঙ্গিয়ে অথবা শোকের লেবাস পরে প্রতিশোধকামী প্রেতাত্মাকে ফাঁকি দেয়া যায়। খুনে ভীতুদের কাছ থেকে বিশ্বাসের অর্ধাংশের উৎপত্তি এবং বাকি অর্ধাংশের জন্ম দিয়েছে খুনীরা।