কর্মচারীদের নিয়ে আবার বিশেষ ধরণের বিপত্তি হতে পারে, কারণ সাধারণতঃ তারা যে সকল লোককে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের থেকে দূরে অফিসে বসে কাজ করে। শিক্ষার কথাই ধরা যাক না কেননা, শিক্ষকেরাই সর্বাঙ্গীনভাবে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দীর্ঘকালের মেলামেশার পর তাদেরকে বুঝতে পারে এবং তাদের সম্পর্কে যত্নবান হতে পারে। তাদেরকে যে সরকারি অফিসারেরা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কোনও বাস্তব অভিজ্ঞা নেই এবং তাদের কাছে শিশুরা নোংড়া ছোকরা ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং শিক্ষকদের স্বাধীনতার ওপর অফিসারদের হস্তক্ষেপ ক্ষতিজনক। সব ব্যাপারে ক্ষমতা তাদের হাতেই কুক্ষিগত যাদের টাকা আছে কিন্তু তাদের হাতে নয় যারা কোথায় টাকা খরচ করতে হবে তা ভালোভাবেই জানে। সুতরাং যাদের হাতে ক্ষমতা আছে সাধারণতঃ তারা অজ্ঞ এবং প্রতিহিংসাপরায়ন; তাদের হাতে যত কম ক্ষমতা থাকে ততই মঙ্গল।
যেখানে বাধতামূলকভাবে নৈতিক স্বীকৃতি আদায় করা যায়, সেখানে বাধ্যতার শক্তিও খুব প্রচণ্ড; যদিও সম্ভব হলে যা তার কর্তব্য বলে ধরে দেয়া হয়, সে ইচ্ছা করলে, তা ফাঁকি দিতে পারে। কোন খোলা পথ না পেলে আমরা বরঞ্চ কর দিতে রাজি হই, যদিও কর আদায়কারী যাদু-মন্ত্র বলে আমাদেরকে উপেক্ষা করে চলে যায়, তখন আমাদের অনেকেই তাকে আমাদের অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেবার প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত অনুভব করিনা। এ সকল ক্ষেত্রে আমরা কোকেন বন্ধের জন্য তাড়াহুড়া করি, যদিও সময়-সময়ে তারা বিদ্রোহের খেলা খেলতে ভালবাসে। ছেলেদের অনুপম বৈশিষ্ট্য হলো তাদের ওপর যাদের শাসন চলে তাদেরকে তারা ভালোবাসে মাঝে মাঝে; যেখানে এ অবস্থা, সেখানে শিশুরা সাধারণতঃ শাসনকর্তাদের সম্পর্কে কোন অশ্রদ্ধা পোষণ করেনা, যদিও তারা মাঝে মাঝে তাদের বিরোধিতা করে থাকে। শিক্ষাবিভাগীয় কর্তাদের শিক্ষকদের মত এ গুণ নেই। তারা যেভাবে রাষ্ট্রের ভালো হবে মনে করে সেভাবে দেশপ্রেম শিক্ষা দিয়ে শিশুদের কোরবান করে। তাহলে সামান্যতম কারণে হত হওয়ার এবং হত্যা করার ইচ্ছাকে শাণিয়ে তোলা। যারা শাসিতদের হিত কামনা করে তাদের হাতে ক্ষমতা থাকলে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতি সাধিত হতো। কিন্তু এ ব্যাপারে সফলতা লাভ করার কোন পদ্ধতি আমাদের জানা নেই।
শাসিতেরা যখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, আইনের বলে তাদেরকে শাসন করা হচ্ছে তা দূরভিসন্ধিমূলক এবং ক্ষতিকর, তখন বাধ্যবাধকতার বিষময় ফল হবে। একজন মুসলমানকে শুকরের মাংস অথবা একজন হিন্দুকে গোমাংস বাধ্য করে খাওয়ান সম্ভব হলেও কাজটা যে চূড়ান্ত ঘৃণ্য হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যারা টিকা দেওয়া অন্যায় মনে করে তাদেরকে টিকা নিতে বাধ্য করাও উচিত নয়, তবে প্রশ্নটা স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, কেননা দু’ব্যাপারে কোনটাতেই তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয় না। প্রশ্নটি পিতামাতার সঙ্গে রাষ্ট্রের কোন সাধারন নীতি অনুসারে তা সমাধান করা যাবেনা। যে পিতামাতার সন্তানকে শিক্ষা দেয়ার বিরুদ্ধে সুচিন্তিত মতবাদ রয়েছে, তাদের শিশুদেরও অশিক্ষিত করে রাখবার কোন অধিকার নেই। তার পরেও সাধারণ নীতি যতদূর যায়, দুটি ব্যাপারই পরস্পর সাদৃশ্যাত্মক।
একজন মানুষ যে জিনিস সমূহ অন্যের বদৌলতে লাভ করে এবং একজনের যে জিনিস লাভের ফলে পরের কোন অনিষ্ট হয় না, এ দুয়ের মধ্যবর্তী প্রভেদটুকুই হলো স্বাধীনতার ব্যাপারে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমি যদি খাদ্যদ্রব্যের ন্যায্য অংশের চাইতে বেশি দাবি করি তাহলে অন্য একজন মানুষকে সেজন্য উপোষ করতে হবে, কিন্তু যদি আমি অসাধারনভাবে গণিতশাস্ত্রে আত্ননিয়োগ করি তাহলে শিক্ষাব্যবস্থাকে সুযোগ সুবিধা একচেটিয়া না করে ফেললে কারো কোন ক্ষতি করবে না। এখানে আরো একটি প্রসঙ্গ রয়ে গেছে খাদ্য, বাসস্থান এবং পোষাক হলো জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়, সে ব্যাপারে একজন মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের বিশেষ কোন মতভেদ নেই। সুতরাং গণতন্ত্রে সরকারি কার্যপরিচালনার পক্ষে সেগুলো খুবই উপযুক্ত এবং প্রয়োজনীয়। এসব ব্যাপারে ন্যায়বিচার শাসনতান্ত্রিক রীতি হওয়া উচিত। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশে ন্যায়বিচারের অর্থ হলো সমতা। কিন্তু যে দেশে উত্তরাধিকারসূত্রে শ্রেণীসমূহের পরম্পরা বর্তমান, উচ্চ-নীচ সকলের দ্বারা স্বীকৃত সে দেশে ন্যায়বিচারের অর্থ সমতা নয়। এমনকি ইংল্যাণ্ডের অধিকাংশ মজুরদের কাছেও যদি বলা হয় তাদের এত রাজারও কোন জাকজমক থাকা উচিত নয়, তাহলে তারা মূচ্ছা যাবে। সুতরাং একেবারে কম ঈর্ষার সঞ্চার করে মত ন্যায় বিচারের সংজ্ঞায়ন করতে চাই। কুসংস্কার, মুক্ত সমাজে সমতাই হলো ন্যায়বিচার, কিন্তু যে সমাজ দৃঢ়ভাবে সামাজিক অসামোর উপর বিশ্বাস প্রবণ সে সমাজে নয়।
কিন্তু নীতি, চিন্তা, শিল্প ইত্যাদির দিক নিয়ে একজন মানুষ অন্যের বদৌলতে, নিজের অধিকার অর্জন করতে পারে না। অধিকন্তু এ ক্ষেত্রে কোনটা ভালো তাও যথেষ্ট সন্দেহজনক। কেননা কেউ পোলাও-কোর্মা খায় আর কেউ পান্তাভাতও খেতে পায় না। যদি সুখি পোলাও কোরমা খাওয়া মানুষ দারিদ্রের সুফল প্রচার করে তখন তাকে একজন কপট ভাবা হবে। যদি আমি অঙ্ক পছন্দ করি এবং অন্য একজন মানুষ গান পছন্দ করে, তখন আমরা পরস্পরের ওপর কোন হস্তক্ষেপ করিনা, যখন আমরা পরস্পরের প্রশংসা করি তখন আমরা পরস্পরের প্রতি ভদ্রতা পোষণ করি। মতামতের ক্ষেত্রে স্বাধীন প্রতিযোগিতা হলো সত্যে পৌঁছুবার একমাত্র পন্থা। প্রাচীন উদারনৈতিক নীতি বাক্যগুলো অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে অপব্যবহারই করা হয়েছে। মানসিক ক্ষেত্রেই সেগুলো সত্যিকারভাবে প্রযোজ্য। আমরা ব্যবসায়ে নয় আদর্শের ক্ষেত্রেই স্বাধীন প্রতিযোগিতা কামনা করি। মুশকিল হলো, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে স্বাধীন প্রতিযোগিতা মারা গেলে বিজয়ীরা মানসিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিস্তার করে এবং সৎচিন্তা এবং সজীবনধারণের নামে সকলকে মজুর বানিয়ে ছাড়ে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, কেননা চিন্তার অর্থ হলো কপটতা এবং সৎজীবন ধারণের অর্থ হলো বোকামি। সমাজতন্ত্র অথবা গণতন্ত্রে শ্রেষ্ঠতম বিপদ হলো, অর্থনৈতিক নির্যাতনের জন্য সর্বপ্রকার মানসিক এবং নৈতিক উন্নতি উভয় পদ্ধতির মধ্যেই অসম্ভব। কোন মানুষের ধর্ম যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ শ্রদ্ধা পোষণ করা উচিত। তা না হলে আমাদের নির্যাতনকারী প্রবৃত্তিসমূহ ষোড়শ শতাব্দীর স্পেনের মতো একটি ছাঁচে ঢালা সমাজের সৃষ্টি করবে। বিপদ সত্যিকার এবং সন্নিকট। আমেরিকা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার মূল্য না বুঝতে পারলে আমাদের ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হবে। সে স্বাধীনতা আমাদের চাওয়া উচিত তা অপরকে অত্যাচার করার অধিকার নয়, আমাদের পছন্দ এবং ধারণা অনুসারে জীবনধারণ করার অধিকার যা জীবনধারণ করতে বাধা দান করে না।