আমি যৌন প্রয়োজন এবং পিতৃত্বের অধিকার সম্বন্ধে কোন আলোচনা করব না। আমি শুধু বলব যে দেশে নরনারীর মধ্যে এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীর তুলনায় ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রচলিত ব্যবস্থা মতে কদাচিত যৌন প্রয়োজন এবং পিতৃত্বের দাবি মিটানো যায় সে দেশে, তদৃপরি কঠোর খ্রিষ্ঠান ঐতিহ্যের অশুভ প্রতিক্রিয়া মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। রাজনৈতিকদের পক্ষে মানব প্রবৃত্তি সম্পর্কে অবগত হওয়ার কোন সময় নেই যে বিশেষ বিশেষ আকাঙ্খ সাধারণ নরনারীকে চালিত করে সে বিষয়ে তাদরেকে একেবারে অজ্ঞই বলতে হবে। রাজনৈতিক পার্টির নেতাদের সামান্য মাত্র মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকলেও তারা সমগ্র দেশকে পরিষ্কার অনাচারমুক্ত করে গড়তে পারত।
সকলের জৈবিক প্রয়োজন সরবরাহ করার জন্যে সমাজ ব্যক্তির ওপর যে হস্তক্ষেপ করে বিমূর্ত ভাবে তা স্বীকার করলেও একজন মানুষ অন্যজনের বদৌলতে কিছু অর্জন করলে তার ওপর যে সমাজ হস্তক্ষেপ করবে, এটা আমি স্বীকার করতে পারি নে। আমি এসকল বিষয়কে মতামত, জ্ঞান এবং শিল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে চিন্তা করি। যেহেতু অধিকাংশ মানুষ অন্যের অধিকারের যা আছে তার ওপর যে মতবাদ হস্তক্ষেপ করে না সে মতবাদকে পছন্দ করেনা। সমাজের অধিকাংশ মানুষ কতেক বিষয় সম্বন্ধে জানতে অনাগ্রহী, কিন্তু যারা জানতে চায় তাদেরকে কারাগারে প্রেরণ করার কোন অধিকার তাদের নেই। আমি একজন মহিলাকে জানি যিনি টেক্সাসের পারিবারিক জীবনের ওপরে একটি বই লিখেছেন এবং বইটিকেও আমি সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই প্রয়োজনীয় মনে করি। ব্রিটিশ পুলিশ মনে করে যে কোন বিষয়ের সত্য জানার কারো অধিকার নেই, সুতরাং ডাক যোগে ঐ বই প্রেরণ করাকে বেআইনী ঘোষণা করল। সকলেরই জানা কথা অনেক সময় মনঃসমীক্ষকেরা অন্তরের মধ্যে চীর ধরা অবদমিত স্মৃতিকে জাগরিত করে রোগীকে আরোগ্য করে তোলে। সমাজও কিছু অংশে মনোবিকল রোগীর এত। কিন্তু অরোগ্য লাভ করার চাইতে যে চিকিৎসকেরা অপ্রিয় সত্যকে দিনের আলোকে প্রকাশ করে, সে চিকিৎসকদেরকে কারারুদ্ধ করে রাখে। স্বাধীনতার ওপর এ হামলা কোনক্রমেই সমর্থন করা যায় না। একই যুক্তিতে ব্যক্তিগত নৈতিকতার উপর হস্তক্ষেপ করা হয়, যেমন একজন মানুষ যদি দুটি স্ত্রী গ্রহণ করতে চায় অথবা একজন স্ত্রীকে দু’জন স্বামী, এটা তার বা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, এর বিরুদ্ধে কারো কোন ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না।
এতক্ষণ পর্যন্ত বিমূর্ত যুক্তির আলোকে স্বাধীনতার ওপর ন্যায় সঙ্গত হস্তক্ষেপের সীমারেখা সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এখন আমি কতকগুলো অধিকতর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনা করব।
আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক দুরকমের। সামাজিক এবং শারীরিক। বাধা তা সামাজিক এবং শারীরিক যে রকমই হোক না কেননা স্বাধীনতার ঘাটতি হলো প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি। কিন্তু সামাজিক বাধা অধিকতরো ক্ষতিজনক কেননা এর ফলে অতৃপ্তির সৃষ্টি হয়। একটা ছেলে গাছে চড়তে চায়, আপনি তাকে বারণ করলে সে ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়ে উঠবে; কিন্তু যদি তার শারীরিক কারণে চড়তে না পারে তাহলে সে শরীরকেই দোষী করবে। সময়ে গীর্জায় যাওয়া; সেগুলো করতে দেয়া উচিত। অতৃপ্তিকে অবদমন করার জন্যে সরকার দুর্ভাগ্যের সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের যোগসুত্র আবিষ্কার করে এবং অতৃপ্তি সৃষ্টি করার জন্যে বিরোধীদলীয় মানুষের কাজকেই দায়ী করে। রুটির দাম বেড়ে গেলে সরকার বলে খারাপ শস্যোৎপাদনের কারণে হয়েছে, বিরোধীদল বলে মুনাফাখোরদের চক্রান্তেই রুটির দাম বেড়েছে। শিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মানুষের অসীম শক্তিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। তারা ভাবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিরসন করার জন্যে মানুষ যা করতে পারে তার কোন সীমারেখা নেই। সমাজতন্ত্রও ঠিক তেমনি এক ধরণের বিশ্বাস, দারিদ্র্য, আল্লাহতাআলা প্রেরণ করে বলে আমরা মনে করি না, বরঞ্চ মনে করি মানুষের নিষ্ঠুরতা এবং বোকামির ফল। এই বিশ্বাস সঙ্গতিবানদের প্রতি সর্বহারার দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দিয়েছে। মানুষের অসীম ক্ষমতাকে অনেকদূর নিয়ে বেশী বড় করে দেখানো হয়েছে। ভূতপূর্ব স্বাস্থ্যমন্ত্রী সহ অনেক সমাজতন্ত্রী বিশ্বাস করেন যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষ প্রচুর খেতে পাবে, যদি ভূ-পৃষ্ঠে জনসংখ্যা প্রবলভাবে বেড়ে যায় তবুও কেনো খাদ্য ঘাটতি হবে না। এরকমের বাড়াবাড়িকে আমি ভয় করি। সে যাহোক, মানুষের অসীম শক্তিতে আধুনিক কালে যে বিশ্বাস জন্মেছে, পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নিলে তা অতৃপ্তিকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। দায়ী করার উপযুক্ত কারণ থাকা সত্ত্বেও এখন দুর্ভাগ্যের জন্য প্রকৃতি এবং খোদা ইত্যাদিকে দায়ী করা হয় না। তার ফলে অতীতের সমাজকে যত সহজে শাসন করা যেতো বর্তমান সমাজকে তত সহজে শাসন করা যায় না; এর কারণ হলো শাসক শ্ৰেণী অত্যধিকভাবে ধার্মিক এবং তাদের কৃত অপরাধের ফলে যে দুর্ভাগারা ভোগে তাদের তারা আল্লাহর নির্দেশ বলে চিহ্নিত করে। আধুনিক যুগে পূর্বকালের এত নূন্যতম প্রয়োজনীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা যুক্তিসঙ্গত তা প্রমাণ করা যাবে না, কেননা হস্তক্ষেপ ক্রিয়াকে অপরিবর্তনীয় আইনের ছদ্মবেশ পরিয়ে আত্নগোপন রাখা সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও পুরাতনেরা প্রত্যেকদিন দৈনিক টাইমসে চিঠি লিখে এ পুরনো পদ্ধতি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তা ছাড়াও আরো দুটো কারণে সামাজিক স্বাধীনতার বিরোধিতা করা হয়। প্রথমটা হলো মানুষ অন্যের উন্নতি কামনা করে না বরং দ্বিতীয়টি হলো কিসে পরের উন্নতি হয় তা তারা জানে না। বোধহয় মূলতঃ দুটো কারণই, একটি কারণের এপিঠ ওপিঠ। যখন আমরা আন্তরিকভাবে কোন মানুষের ভালো কামনা করি তখন আমরা তার আসল অভাব কি সে সম্বন্ধেও অবগত হই। মানুষ প্রতিহিংসা বশতঃ ক্ষতি করুক অথবা অজ্ঞতার কারণেই ক্ষতি করুক বাস্তবে তা একই রকমের ফলদান করে। সুতরাং আমরা একসঙ্গে দুটো কারণকে নিয়ে বলতে পারি একটি মানুষকে অন্য একটি মানুষের একটি শ্রেণীকে অন্য একটি শ্রেণীর স্বার্থের সংরক্ষক বলে এখনো বিশ্বাস করা যায় না। অবশ্য গণতন্ত্রের ভিত্তি এ যুক্তির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের গনতন্ত্রকে বিভিন্ন কর্মচারীর মাধ্যমে কাজ করতে হয় বলে ব্যক্তিসাধারণের কাছে এর আবেদন অপ্রত্যক্ষ এবং ভাসাভাসা।