এ কথাও পরিস্কার যে শুধু মাত্র সরকারি শাসনের কড়াকড়ি হ্রাস করে স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা যাবে না। একজন মানুষের আকাঙ্ক্ষা অন্য একজন মানুষের আকাক্ষার সঙ্গে মিলে না। সে জন্য অরাজকতা বলতে বেঝায় শক্তিমানের স্বাধীনতা এবং দুর্বলের দাসত্ব। আজকে পৃথিবীর যে জনসংখ্যা সরকারি শাসন না থাকলে অনাহার এবং শিশুমৃত্যুর ফলে, দশভাগের এক ভাগও থাকত কিনা সন্দেহ। শারীরিক দাসত্বের স্থলে সভ্য সমাজ স্বাভাবিক অবস্থায়ও যে জঘন্য সামাজিক দাসত্বের প্রবর্তন করেছে তা আরো ভয়াবহ এবং মারাত্নক। এখন আমাদের যে সমস্যাটি বিবেচ্য, তা হলো কি করে সরকার ছাড়া চলতে হয় তা নয়, বরঞ্চ স্বাধীনতার ওপর বিন্দুমাত্র হামলা না হয় মতো এর সুবিধা গুলো ভোগ করা। তাহল শারীরিক এবং সামাজিক স্বাধীনতার মধ্যে সামাঞ্জস্যবিধান করা। সুলভাবে দেখতে হলে তা এই দাঁড়ায় যে, বেশী খাদ্য এবং ভালো স্বাস্থের জন্য আমরা কি পরিমান সরকারি চাপ সহ্য করতে রাজি থাকব?
এ প্রশ্নের জবাব বাস্তবে দিতে গেলে একটা সহজ বিবেচনা আমাদের করতে হবে; আমাদের কি খাদ্য এবং স্বাস্থ্য দুটোই চাইতে হবে না কোন বিশেষ একটি চাইলে আমাদের চলবে? কোন লোক বন্দী অবস্থায় অথবা ১৯১৭ সনের ইংল্যান্ডে মানুষ যে কোন ধরনের সরকারি চাপ সইতে রাজি ছিল, কেননা স্পষ্টতঃ তা ছিল সকলের স্বার্থের অনুকুলে। কিন্তু কাউকে যদি সরকারি চাপ সহ্য করতে হয় এবং কাউকে যদি খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়ায় সম্পূর্ন ভিন্ন রকম। এতে আমরা সমাজতন্ত্রবাদ এবং ধনতন্ত্রবাদের মাঝামাঝি এক অবস্থার সম্মুখনি হই। ধনতন্ত্রের সমর্থকরা স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীনতার পবিত্র নীতির নামে আবেদন করবে যার সবটুকু একটি মাত্র নীতিবাক্যের অন্তরালে নিহিত। নীতিবাক্যটি হলো, “ভাগ্যবানদেরকে হতভাগ্যদের ওপর অত্যাচার করতে অবশ্যই বাধা দিতে হবে।”
এই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীনতাই হলো হস্তক্ষেপহীন অবাধ স্বাধীনতা, তাকে কোনমতেই অরাজকতা বলে গ্রহন করা চলে না। হস্তক্ষেপহীন স্বাধীনতা আইন বলে খুন-জখম দমন করে এবং দুর্ভাগাদের সশস্ত্র বিপ্লব দমন করতে যত কাল পর্যন্ত সাহস করছে ততকাল টেড ইউনিয়ন করতে বাধা দান করছে। এই ন্যূনতম সরকারি সুবিধা ছাড়া বাদবাকিগুলো অর্থনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা পূরণ করাই ছিল অভীষ্ট লক্ষ্য। স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে একজন মালিক কর্মচারীদের বলতে পারে, “তোমরা তিলে তিলে অনাহারে মরবে।” কিন্তু স্বাধীনতা এমন কোন সুযোগ কর্মচারীদের দেয়নি যার ফলে তারা দাঁতভাঙ্গা জবাব বলতে পারে মালিককে,”তার আগে তোমাকে আমাদের গুলিতে মরতে হবে। কোন রকমের আইনের পাণ্ডিত্যের কচকচি ছাড়া এ দুপ্রকার ভীতির মধ্যে কোনরকম ইতর বিশেষ করা অনেকটা হাস্যাস্পদ। দুটোর প্রত্যেকটাই স্বাধীনতার ন্যূনতম প্রয়োজনকে সংকুচিত করে রাখে, এতে শুধু একটা নয় দু’টা কারণই সক্রিয় সমানভাবে। একমাত্র অর্থনৈতিক দিগন্তে এ অসাম্য সীমাবদ্ধ নয়। স্বাধীনতার পবিত্র নীতি স্বামীকে স্ত্রীর ওপর পিতাকে পুত্রের ওপর নির্যাতন করার আইনতঃ অধিকার দান করেছে, কিন্তু প্রচার করেছে স্বাধীনতা অবশ্যই সর্বপ্রথম এ বিরোধ সমূহের নিস্পত্তি করবে। কারখানাতে কাজ করতে বাধ্য করতে পুত্রের পিতা যে নির্যাতন করেছে উদারনৈতিকদের উপস্থিতি সত্ত্বেও তার ফয়সালা হয়ে গেছে।
কিন্তু বিষয়টি হলো আলোচিত, সে জন্যে আমি এর ওপর বিশেষ কিছু বলে সময় নষ্ট না করে সাধারণ প্রশ্নের প্রতি আলোকপাত করতে চাই তাহলো সমাজ কতকাল ব্যক্তির ওপর, ব্যক্তির কারণে নয় সামাজিক কারণে হস্তক্ষেপ করবে? এবং কি উদ্দেশ্যের জন্য হস্তক্ষেপ করবে?
শুরুতেই আমাদের বলা উচিত, স্বাধীনতার ন্যূনতম প্রয়োজন খাদ্য, পানীয়, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পোশাক জৈবিক প্রয়োজন এবং পিতৃত্বের দাবিকে অন্যান্য সকল রকমের দাবীর উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। ওপরে বর্ণিত ন্যূনতম প্রয়োজন সমূহ মানুষের জৈবিক প্রয়োজন এবং পিতৃত্বের দাবিকে অন্যান্য সকল কর্মের দাবীর উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। ওপরে বর্ণিত ন্যূনতম প্রয়োজন সমূহ মানুষের জৈবিক বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। একটু আগে যে সকল বিষয়ের কথা বলেছি সেগুলো প্রয়োজনীয়তার বাইরে যে বিষয় সমূহ আছে সেগুলো অবস্থানুসারে স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। একজন মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত করে অন্য একজন মানুষের প্রয়োজনে সাড়া দেয়াকে আমি প্রাথমিকভাবেই যুক্তিযুক্ত মনে করি। কোন বিশেষ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোন বিশেষ সমাজে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থানুসারে তা হয়ত প্রয়োগক্ষম নাও হতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তা কখনো আপত্তিজনক নয়। একজন মানুষকে তার প্রয়োজনীয় দাবি থেকে বঞ্চিত করলে তার স্বাধীনতার ওপর যে হস্তক্ষেপ করা হয়, বাড়তি দাবি থেকে বঞ্চিত করা হলে ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর তার চেয়ে বেশি হস্তক্ষেপ করা হয়।
যদি একথা স্বীকার করে নেয়া হয়, তাহলে তা আমাদেরকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ স্বাস্থ্যের কথা ধরা যাক ব্যুরো কাউন্সিলের নির্বাচনের সময় সরকারি অর্থের কি পরিমাণ জনস্বাস্থ্য, প্রসূতি সদন এবং শিশু মঙ্গলের কাজে ব্যয়িত হবে, সে প্রশ্ন খুবই উল্লেখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। হিসাব করে দেখা গেছে এ সকল কাজে ব্যয়িত অর্থ জীবন রক্ষার কাজে প্রচুর উপকারে আসে। লণ্ডনের প্রায় প্রত্যেক ব্যুরোর ধনীরা একযোগে এসবে যাতে ব্যয় বৃদ্ধি না হয়, বরঞ্চ ব্যয় সঙ্কোচের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের অভিপ্রায় হলো, হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যু গহবরে ঠেলে দিতে তারা প্রস্তুত যার বদৌলতে তারা মোটর গাড়িতে চড়তে পারে এবং নৈশভোজের ব্যবস্থা করতে পারবে। তারা সমস্ত সংবাদ পত্র নিয়ন্ত্রণ করবে বলেই তাদের কীর্তি কলাপের কাহিনী তারা যে সকল মানুষকে নির্যাতন করে তারা জানতে পারে না। মনঃসমীক্ষকদের কাছে পরিচিত এমন এক পদ্ধতি অবলম্বন করে তারা নিজেরাও সত্যকে এড়িয়ে যায়। তাদের কার্যকলাপের মধ্যে বিস্মিত হওয়ার কোন কিছু নেই; সকল যুগের অভিজাতদের এইই পরিচয়। আমার যা বক্তব্য তা হলো স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের সকল কীর্তি কলাপ কোন ক্রমেই সমর্থন যোগ্য নয়।