যদিও মানুষের আকাঙ্খার মধ্যে বিভিন্নতা আছে তবুও কতিপয় মৌলিক প্রয়োজন রয়েছে যে গুলোকে সার্বজনীন অভাবের পর্যায়ে দেখা যায়। খাদ্য, পানীয়, স্বাস্থ্য পোশাক, বাসস্থান, যৌন প্রয়োজন এবং পিতৃত্ব ইত্যাদি তার মধ্যে প্রধান। (গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ সমূহে পোশাক এবং বাসস্থানের অভাব এত তীব্র এবং প্রখর নয়, বিষুবীয় অঞ্চল ছাড়া অন্যান্য দেশের মানুষের প্রয়োজনের তালিকায় এ দুটোকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।) স্বাধীনতা বলতে যাই বোঝাক না কেননা; ওপরের তালিকায় যে সকল প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে, কোন মানুষ তার একটি থেকে বঞ্চিত হলেও তাকে স্বাধীন বলা যায় না; যেহেতু উপরের তালিকার মধ্যে স্বাধীনতার ন্যূনতম প্রয়োজনের কথাই বলা হয়েছে।
এজন্যে আমাদের সমাজের সংজ্ঞায় ফিরে আসতে হয়। ওপরে যে ন্যূনতম স্বাধীনতার কথা বলা হলো রবিনসন ক্রুশোর মতে নির্জন বাসের চাইতে সামাজিক জীবনে তার রূপায়ন অধিকতর সহজ। যৌন প্রয়োজন এবং পিতৃত্ব এ উভয় প্রয়োজন নিতান্তই সামাজিক। একদল মানুষ কতেক নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে সহযোগিতার ফলশ্রুতিই যে সমাজ, যে কোন লোক সমাজের এ সংজ্ঞায়নই দান করবে। মানুষের আদিমতম সামাজিক সংগঠন হলো পরিবার। অর্থনৈতিক সামাজিক সংগঠনের উৎপত্তিও আদিম যুগে হয়েছিল। আপাততঃ দৃষ্টিতে দেখা যায় যে সকল সংগঠন যুদ্ধ করার জন্যে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে তার উৎপত্তি তত আদিম কালে নয়। আধুনিক যুগে অর্থনীতি এবং যুদ্ধ হলো সামাজিক সংঘর্ষের প্রধান কারণ। পরিবার এবং গোত্রের চাইতে বৃহত্তর সামাজিক সংগঠন না থাকলেও আমরা সকলে আমাদের শারীরিক প্রয়োজন খুবই ভালোভাবে মিটাতে পারত। ঐ অর্থে সমাজ আমাদের স্বাধীনতা বৃদ্ধি করার কাজে নিয়েজিত রয়েছে। সুসংগঠিত রাষ্ট্রে বসবাস করলে আমাদের শত্রু কর্তৃক নিহত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, তা হলো একটি সন্দেহজনক বক্তব্য।
একজন মানুষের আকাঙ্খা সমূহকে যদি আমরা সত্য বলে গ্রহণ করি তার মানে, তার মনস্তাত্ত্বিক গতিবাদকে অস্বীকার করি তাহলে তার স্বাধীনতার দুরকম প্রতিবন্ধক আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাব; সেগুলো তার শারীরিক এবং সামাজিক প্রতিবন্ধক। স্কুল দৃষ্টান্তের সাহায্যে তা দেখানো যায়, যেমন, পৃথিবী তার বেঁচে থাকার মতো খাদ্য উৎপাদন করে অথবা অন্য মানুষ তার খাদ্য সংগ্রহে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ স্বাধীনতার শারীরিক বাধায় অবসান ঘটিয়ে সামাজিক বাধার সৃষ্টি করেছে। সে যাহোক, এখানে আমরা আকাঙ্খর ওপর সামাজিক প্রভাবের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সবিশেষ ওয়াকেবহাল না হলে ভুল পথে যেতে বাধ্য হব। একজন মানুষ ধরে নিতে পারে যে, পিঁপড়ে এবং মৌমাছি যদিও সংঘবদ্ধ সমাজে বাস করে তবুও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সামাজিক কর্তব্য করে যায়। উন্নত শ্রেণীর প্রাণী যেগুলো সমাজবদ্ধভাবে বাস করে, তাদের প্রত্যেকটি সম্বন্ধে একই কথা সত্য। রিভার্সের মতে কম বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষের সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। তা আবার দেখা যায় অধিক পরিমাণ ইঙ্গিতময়তার উপর নির্ভরশীল কম বেশি ইন্দ্রজালে যা ঘটে থাকে সে সমস্ত উপাদানের সমগোত্রীয়। এ ভাবে মানুষের সমাজ গঠিত হলে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে স্বাধীনতা বিসর্জন না দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে এবং আইনের খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। কি আশ্চর্য যদিও সভ্য মানুষের অসভ্যদের থেকে অধিকতর উন্নত সামাজিক সংগঠন রয়েছে, কিন্তু প্রবৃত্তির দিক দিয়ে তাদেরকে অসভ্য মানুষের তুলনায় কম সামাজিক আচরণ করতে দেখা যায়, যা তাদের উপর সমাজের প্রতিক্রিয়া অসভ্যদের তুলনায় অধিকতর বাহ্যিক এবং পোশাকী। সে কারণে তাদেরকে স্বাধীনতার সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে হয়।
সবচেয়ে সভ্য সম্প্রদায়েও সামাজিক সহযোগিতার মর্মমূলে যে প্রবৃত্তিগত ভিত্তি বর্তমান তা আমি তা স্বীকার করতে চাইনে। মানুষ প্রতিবেশীকে ভালোবাসতে এবং তাদের ভালোবাসা পেতে আগ্রহ পোষণ করে। তারা পরস্পরের অনুকরণ করে এবং ইঙ্গিত মারফত মনোভাব বুঝতে পারে। তা সত্বেও সভ্য হওয়ায় চরিত্রের এ উপাদান নিচয় শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। স্কুলের ছাত্র থাকার সময়ে তাদের যে পরিমান শক্তি তাদের থাকে না, সামগ্রিকভাবে কম বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন মানুষের ওপর তারা ক্ষমতা বিস্তার করে সামাজিক সহযোগিতার ফলে যে সুবিধা পাওয়া যায়, ক্রমশঃ জ্যান্ত প্রবৃত্তির ঢিলে ঢালা স্তর অতিক্রম করে বিচার বুদ্ধির উপর নির্ভর করতে শুরু করছে। অসভ্যদের সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতার কোন প্রশ্ন জাগতে পারে না। যেহেতু তারা এর কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। সভ্য মানুষেরা আরো সভ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা তীব্র হতে তীব্রতর রূপে অনুভব করেছে। একই সঙ্গে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা ধারাবাহিক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সরকার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকে যে আমাদের স্বাধীনতাকে মুক্ত করতে পারে আগের তুলনায় তা অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সুতরাং সামাজিক স্বাধীনতা সমস্যার দিকে নজর দেয়া খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে, তা না হলে আমরা অধিকতর সভ্য হয়ে উঠতে পারব না।