এ প্রবন্ধে সর্বত্র আমি বলতে চেয়েছি বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদ্ভূত ফলাফল থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক, বৈজ্ঞানিক মেজাজের মাধ্যমে মানুষের মনের সজীবতা ফিরে পাওয়া যায় এবং আমাদের সকল রকমের অসুবিধা দূর করার পদ্ধতি প্রদান করতে সক্ষম। বিজ্ঞাপনের ফলাফল যান্ত্রিক পদ্ধতিতে, বিষাক্ত গ্যাসে, সংবাদপত্রের প্রচারে আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করার হুমকী প্রদর্শন করেছে। যুদ্ধবাজেরা খণ্ডিত আনন্দে বিভোর হয়ে যা করে সভ্যতার পক্ষে তা অত্যন্ত মারাত্মক। কিন্তু আমাদের কাছে তা জীবন মরণের শামিল। এরই ওপর নির্ভরশীল আমাদের পৌত্র পৌত্রেরা অধিকতর সুখী পৃথিবীতে বসবাস করবে না বিজ্ঞাপনের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে একে অপরের বিনাশ সাধন করবে। মানব গোষ্ঠীর মধ্যে বোধ হয় শুধু নিগ্রো এবং পেপুয়ানেরাই বেঁচে থাকতে পারবে।
১৩. সমাজে স্বাধীনতার পরিধি
সামাজিক মানুষের জন্য কি পরিমান স্বাধীনতার প্রয়োজন এবং কতোদূর স্বাধীনতা সমাজে আচরনকরা সম্ভব এ সাধারন সমস্যাটি হলো আমার আলোচনার বিষয়।
‘স্বাধীনতা‘ এমন একটি শব্দ যাকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন রকমের সংজ্ঞার মধ্যে যুক্তিসহকারে আলোচনা করে লাভবান হতে হলে একটি বিশেষ সংজ্ঞার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। সুতরাং স্বাধীনতার সংজ্ঞাসমূহের সম্বন্ধে আমাদের আলোচনা শুরু করা অধিকতর সুবিধাজনক হবে। ‘সমাজ’ শব্দটির মধ্যে দু রকমের কোন অর্থ নেই। কিন্তু তার সংজ্ঞায়ন প্রচেষ্টার মধ্যে যে কোন রকমের গলদ থাকতে পারেনা এমন কোন কথা নেই।
আমিও শব্দগুলোকে মামুলি অর্থে ব্যবহার করা উচিত মনে করি না; দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, হেগেল এবং তার শিষ্যবেন্দর ধারনা ছিল, পুলিশের হুকুম যা তারা নৈতিক আইনে মনে করত, তামিল করার অধিকারের মধ্যেই সত্যিকারের স্বাধীনতার পুরোপুরি তাৎপর্য বিদ্যমান। অবশ্য পুলিশকেও বাধ্যতামূলক ভাবে তাদের উচ্চপদস্থ অফিসারদের মেনে চলতে হয়। সরকারের কি কর্তব্য এ সংজ্ঞার মধ্যে তার কোন সুনির্দিষ্ট সীমারেখা ব্যক্ত করা হয়নি। প্রচলিত মতানুসারে এ মতবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে বক্তব্য সে অনুসারে রাষ্ট্র হলো সংজ্ঞামতে নিরংকুশ নিষ্পাপ একটি প্রতিষ্ঠান। যে দেশে গণতন্ত্র এবং পার্টি সরকার বর্তমান সেখানে এ সংজ্ঞা বলতে গেলে অচল। কেননা ওসব দেশে অর্ধেক মানুষ সরকারকে মন্দ বলে বিশ্বাস করে। সুতরাং আমরা ওপরে বর্ণিত সত্যিকারের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতার বদলে গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকতে পারিনা।
মূলতঃ বিমূর্ত অর্থে আকাঙ্খর রূপায়নে বাহ্যিক বাধার অভাবকেই স্বাধীনতা বোঝায় এ বিমূর্ত অর্থ মেনে নিলে ক্ষমতা বৃদ্ধি করে অথবা অভাব কমিয়ে স্বাধীনতার হ্রাস বৃদ্ধি ঘটান সম্ভবপর। একটি পতঙ্গ কয়েকদিন জীবন ধারণ করে ঠাণ্ডায় মারা গেলে উল্লেখিত সংজ্ঞানুসারে বলতে হবে তার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। শীতের কারণে মারা গেলে পতঙ্গের সকল ইচ্ছার পরিসমাপ্তি ঘটবে, তখন অসম্ভবকে সম্ভব করা তার দ্বারা হয়ে উঠবে না। মানুষ এ পদ্ধতি অনুসরণ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনা। একজন রাশিয়ান, অভিজাত যিনি সাম্যবাদী হওয়ার পর লাল ফৌজের কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন আমার কাছে ব্যখ্যা করেছিলেন, ইংরেজদের রাশিয়ানদের মতো বাহ্যিক কোন সোজা জ্যাকেট পরতে হয় না; যেহেতু তাদের আত্মা সকল সময় মানসিক জ্যাকেটের আবরণে আবৃত থাকে। সম্ভবতঃ এ বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা সত্যতা আছে। ডষ্টয়েভস্কির উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সঙ্গে আসল রাশিয়ানদের কোনও সাদৃশ্য নেই; কিন্তু ওসব চরিত্রগুলো আবিষ্কার একমাত্র রাশিয়ানদের দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল। তাদের আশ্চর্য দুর্দান্ত সকল রকমের মারাত্মক আকাঙ্খ রয়েছে, অন্ততঃপক্ষে সচেতনভাবে গড়পড়তা ইংরেজেরা যার থেকে মুক্ত। সুতরাং যে সমাজের সকল মানুষ একে অন্যকে হত্যা করতে চায় সে সমাজের মানুষ শান্ত ইচ্ছাসমপন্ন সমাজের মানুষ থেকে বেশি পরিমাণে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। ক্ষমতার বৃদ্ধি সাধন করার মতো আকাঙ্খকে বিশুদ্ধ করে নেয়ার মধ্যেই স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকাংশ সুযোগ সুবিধা নিহিত।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করার ফলে যে আরেক রকমের প্রয়োজন আমরা অনুভব করি সব সময় রাজনৈতিক চিন্তা ধারার আলোক সম্পাতে তা সন্তুষ্টি বিধান করা যায় না। আমি সে প্রয়োজন সমূহের কথাই বলছি যেগুলোকে মনস্তাত্ত্বিক গতিবিজ্ঞান বলা যেতে পারে। বাহ্যিকভাবে যে অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়, তার মানে রাজনীতির স্বীকৃত সত্য তার সঙ্গে মানুষের প্রকৃতির কোন মিল নেই। কিন্তু বাহ্যিক অবস্থা যে মানুষের আকাঙ্খকে পরিশুদ্ধ করে এটা স্বীকৃত সত্য। বাহ্যিক অবস্থা এবং মানব প্রবৃত্তির মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সঙ্গতি রক্ষা করা হয়। একজন মানুষকে তার চির পরিচিত পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে হঠাৎ অচেনা পরিবেশে ফেলে দেয়া হলে কিছুতেই স্বধীনতা অনুভব করবেনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও নতুন পরিবেশে অভ্যস্থ মানুষ স্বাধীন অনুভব করতে পারে। সুতরাং নতুন পরিবেশের ফলে মানুষের বিভিন্ন আকাঙ্ক্ষার মধ্যে যে পরিবর্তন আসে তা স্মরনে না রেখে আমরা স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা করতে পারি না। এর অনেকগুলো ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অর্জন অত্যন্ত কষ্টসাপেক্ষ, কেননা নতুন পরিবেশ পুরনো আকাঙ্ক্ষার সন্তুষ্টি বিধান করে কিন্তু নূতন জাগা আকাঙ্ক্ষাগুলো অপরিতৃপ্ত থেকে যায়। শিল্পায়নের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ার ফলে এর অনেকগুলো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু তা আবার অনেকগুলো নতুন স্বভাবের জন্ম দিয়েছে। যেমন একজন মানুষ মোটর গাড়ি কিনতে পারেনা বলে অসন্তুষ্ট এবং খুব শিগগির ব্যক্তিগত এ্যারাপ্লেন পেতে চাইবে। আবার একজন মানুষ তার অবচেতন মনের অভাব বোধের জন্য অসন্তুষ্ট হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ আমেরিকানদের প্রয়োজন বিশ্রাম, কিন্তু বিশ্রাম কি জিনিস তা আমেরিকানরা জানেনা। আমার বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের যে অপরাধের ঢেউ এসেছে তার প্রধান কারণ অস্থিরতা।