অযৌক্তিক বিশ্বাসকে ফাঁপিয়ে ফেনিয়ে তোলে বলে প্রোপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে আপত্তি নয়; ধনী এবং ক্ষমতাবানদের অন্যায় সুযোগ দান করে তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধন করে। সত্যিকারের চিন্তার স্বাধীনতার জন্য চিন্তার সাম্যের প্রয়োজন অপরিহার্য। সকল মতামতকে সমান সুযোগ দেয়ার জন্য ঐ উদ্দেশ্যে প্রণীত প্রাঞ্জল আইনের প্রয়োজন রয়েছে। এরকম আইন ক্রিয়াশীল হবেনা। এমন আশা করা যুক্তিসঙ্গত নয়। প্রাথমিকভাবে এ সমস্ত আইনের মধ্যে প্রতিবিধান মিলবে না, আরো ভালো শিক্ষা এবং অধিক হারে সংশয়াপন্ন জনমতের মধ্যে এর আরোগ্যের উপাদানগুলো নিহিত। বর্তমান মুহূর্তে আমি আরোগ্যের ব্যাপারে কোন আলোচনা করবনা।
অর্থনৈতিক চাপ-আমি চিন্তার স্বাধীনতার বিভিন্নদিকের বাধাগুলো সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছি, এখন আমি আসল দিকে আলোকপাত করতে চাই যে দিকের বিপদ সম্পর্কে সঠিক পন্থা অবলম্বণ না করলে বিপদ আরো বাড়তে বাধ্য। চিন্তার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক চাপ যে সকল দেশ সৃষ্টি করে সোভিয়েত রাশিয়া তার শ্রেষ্ঠতম দৃষ্টান্ত। যে দেশে বাণিজ্য, চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার আগে পর্যন্ত কোন লোকের মতামত না পছন্দ হলে তাকে অনাহারে রাখার নিয়ম ছিল। উদাহরণ স্বরূপ ক্রোপেটিকিনের নাম বলা যেতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাশিয়া একমাত্র দেশ যে অন্যান্য দেশের চেয়ে অগ্রসর। ফরাসিদের ড্রিফাস (Dreyfus) মামলার শুরুতে তাকে যে সমস্ত শিক্ষক সমর্থন এবং শেষের দিকে বিরোধিতা করেছেন তাদের সকলকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বর্তমানে আমার সন্দেহ, একজন অধ্যাপক তিনি যতই খ্যাতনামা থোক না কোন, ষ্ট্যান্ডার্ড তেল কোম্পানির সমালোচনা করলে চাকুরি পাবেন, কেননা সকল কলেজের প্রেসিডেন্টরা মি. রাফেলারের দ্বারা উপকৃত হয়েছেন অথবা উপকৃত হওয়ার আশা রাখেন। সমগ্র আমেরিকাতে সমাজবাদীরা মার্কা মারা মানুষ খুব মহান অবদান না থাকলে তাদের পক্ষে চাকুরি পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। যেখানে শিল্পের প্রসার ঘটেছে ব্যাপকভাবে সেখানে কিছু সংখ্যক বিশ্বাসী কর্মচারী রাখার মনোভাব খুবই প্রবল যাতে করে তাদের সাহায্যে সমস্ত শিল্প একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করা অনায়াসসাধ্য হয়ে পড়ে। এ জন্য তারা গোপনে কৃষ্ণ মলাটের বইতে সে সব কর্মচারির নাম লিখে রাখে যাদেরকে বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের যন্ত্র করতে পারা না যায় এবং অনুগত কর্মচারীদের উপোষ থাকতে বাধ্য করা হয়। আমেরিকার একচেটিয়া পুঁজিবাদে রাশিয়ার রাষ্ট্র মালিকানাধীন সমাজতন্ত্রের অনেকগুলো দোষকে পুণঃ প্রবর্তন করা হচ্ছে। স্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মানুষের নিয়োগকর্তা রাষ্ট্র বা অছি কমিটি যাই হোকনা কেন, দূয়ের মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই।
শিল্পের দিক দিয়ে সবচেয়ে উন্নত আমেরিকাতে এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে, যেগুলো ভবিষ্যতে আমেরিকার পর্যায়ে পৌঁছুবার আশা রাখে, সেখানে গড়পড়তা নাগরিককে বিশেষ বিশেষ বৃহৎ মানুষের বিদ্বেষ পরিহার করে বেঁচে থাকতে হয়। আমেরিকাতে এ আবহাওয়া সর্বাধিক। আবার এসব বড় মানুষদের যে ধর্মীয়, নৈতিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে তাদের কর্মচারীরা তার সঙ্গে অন্ততঃ বাহ্যিক দিকে হলেও একমত হবে এ প্রত্যাশা তারা করে খুব বিখ্যাত লেখক না হয়ে কোন মানুষ যদি খ্রিষ্টান ধর্মে অবিশ্বাস পোষণ করে অথবা বিবাহ আইনের শিথিলতায় বিশ্বাসী অথবা কোন বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিষ নজরে পড়ে তার কাছে আমেরিকা সব চেয়ে অপ্রিয় দেশ হয়ে দাঁড়াবে। যে সকল দেশে অর্থনীতি বাস্তবে একচেটিয়াভাবে পরিচালিত হয়, একই ভাবে সে সকল দেশেও চিন্তার স্বাধীনতা বাধা প্রাপ্ত হয়। উনিশ শতকে অন্ততঃ পক্ষে স্বাধীন প্রতিযোগিতা চলতো কিন্তু এখন চিন্তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করার কাজ তখনকার চেয়ে ঢের বেশি বিপজ্জনক। যে লোক মনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, তাকে অবশ্যই পুরোপুরি অকপট ভাবে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে দাঁড়াতে হবে; সেই সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে শিল্পযুগের শৈশবে যে সকল পদ্ধতি অবলম্বন করে সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেছে এখন সেগুলো বাতিল হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে, দুটো সরল নীতি অবলম্বন করলেই প্রায় সকল সামজিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তার প্রথমটা হবে শিক্ষা ব্যবস্থায় অভীষ্ট সমূহের একটা হবে যখন কোনো বিষয়ের পেছনে যুক্তির জোর থাকবে তা সত্য বলে গ্রহণ করা। দ্বিতীয়তঃ দক্ষতার ভিত্তিতে সকলের কর্মসংস্থান করা।
দ্বিতীয় নীতিটি সম্পর্কে প্রথমে আলোচনা করা যাক। কোন মানুষকে চাকুরিতে বহাল করার আগে তার রাজনৈতিক, নৈতিক এবং ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে জানার অভ্যাস হলো আধুনিক কায়দার নির্যাতন। তার এসব জানার অনুসন্ধিৎসা দিয়ে তো তার কর্মদক্ষতা যাচাই করা হয় না। পুরনো স্বাধীনতা বিন্দুমাত্র ব্যবহার না করে আইনমতো যাচাই করা হয় না। পুরনো স্বাধীনতা বিন্দুমাত্র ব্যবহার না করে আইনমতে সহি সালামতে রক্ষা করা যায়। কোন মতামতে বিশ্বাস করার জন্যে কোন মানুষকে অনাহারে থাকতে হলে তার মতবাদ আইনতঃ শাস্তিযোগ্য নয়, জানা তার কাছে আরামপ্রদ কিছু নয়। ক্ষুধার্ত মানুষেরা ইংল্যাণ্ডের গির্জার অধীনে নয় বলে অথবা রাজনৈতিক মতবাদে গোঁড়ামিমুক্ত বলে তাদের জন্য অনুভূতি দিয়ে ভাবে অনেক মানুষ। নাস্তিক মর্মন ধর্মাবলম্বী, গোঁড়া সাম্যবাদী অথবা স্বাধীন ভালোবাসার প্রচারকদের সম্বন্ধে কোমল ধারণা কদাচিত পোষণ করা হয়। এ ধরণের মানুষকে সব সময় খারাপ বলে ধরে নেয়া হয় এবং স্বাভাবিক ভাবে চাকুরি দেয়ার অযোগ্য বলে পরিগণিত করা হয়। মানুষ এই প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে এখনো ভাবনা-চিন্তা করেনি। পরিপূর্ণরূপে শিল্পায়িত রাষ্ট্রে এ ধরণের ব্যাপক অত্যাচার করা হয়।