আমরা আমেরিকা এবং রাশিয়ার কথা বর্ণনা করে যে সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম, তা হলো মানুষ যতদিন রাজনীতির প্রয়োজনে এ গোড়া বিশ্বাসকে পরিহার না করবে ততদিন রাজনীতিতে স্বাধীন চিন্তার স্ফুরণ অসম্ভব। রাশিয়াতে যেমন তেমনি অন্যান্য ব্যাপারে স্বাধীনতার ঘাটতি হলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। কিছু পরিমাণ রাজনৈতিক সংশয়বাদ আমাদেরকে এ দুর্ভাগ্য হতে রক্ষা করতে পারে।
শিক্ষা বিভাগীয় কর্তারা যে তরুণেরা শিক্ষিত হোক এ কামনা করে তা কখনো বিশ্বাস করা উচিত নয়। পক্ষান্তরে তাদের যা সমস্যা তা হলো বুদ্ধি বৃত্তির বিকাশ সাধন না করে তাদেরকে সংবাদ বিশেষজ্ঞ করে তোলার সমস্যা। শিক্ষার দু’রকমের লক্ষ্য থাকা উচিত। প্রথমতঃ পড়া, লেখা, ভাষা শিক্ষা, অঙ্ক ইত্যাদি ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান দান করা। দ্বিতীয়তঃ যে সকল মানসিক অভ্যাস মানুষকে জ্ঞান অর্জন এবং সুস্থবৃত্তি গঠন করতে অনুপ্রাণিত করে মানুষের মধ্যে সে সকল অভ্যাসের সঞ্চার করা। এর প্রথমটিকে সংবাদ এবং দ্বিতীয়টিকে আমরা মেধা বলে অভিহিত করতে পারি সংবাদের থিয়োরিগত প্রয়োজনীয়তা যেমন আছে, বাস্তবেও তার কি তেমন প্রয়োজন? শিক্ষিত মানুষ ছাড়া বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা চলতে পারেনা। কিন্তু মেধার থিয়োরিগত প্রয়োজনীয়তা আছে, তবে তা তেমন কাজে আসেনা। সাধারণ মানুষ যে নিজের জন্য চিন্তা করবে এটা আশা করা যায়না, কারণ যে সকল লোকে তাদের নিজেদের জন্য চিন্তা করে তারা নিজেদেরকেই বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে যায় এবং শাসকদের বিষ নজরে পতিত হয়। প্লেটোর ভাষায় বলতে গেলে একমাত্র অভিভাবকেরাই চিন্তা করবে এবং বাকি সকলে তা মেনে নেবে অথবা একপাল মেষের মতো নেতার অনুসরণ করবে। অবচেতনভাবে এই মতবাদ খুব ক্ষীণভাবে হলেও রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পরেও টিকে আছে এবং সোজাসোজি সমস্ত রকমের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা পদ্ধতির আইন কানুন অগ্রাহ্য করেছে।
বুদ্ধিবৃত্তি ছাড়া সংবাদ পরিবেশন করতে পুরোপুরি যে দেশটি সাফল্য অর্জন করেছে, আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসের শেষ পৃষ্ঠায় যার নাম সম্প্রতি লিখা হলো, সে দেশটি জাপান। পদ্ধতিগত দিক দিয়ে জাপানের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রসংশনীয় বলা যেতে পারে, কিন্তু তাতে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে, সে উদ্দেশ্যটি হলো মিকাডোকে পূজা করার শিক্ষা দেয়া, যার প্রবণতা আধুনিক জাপানে পূর্বাপেক্ষা অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং স্কুল সমূহকে একই সঙ্গে জ্ঞান বিস্তার এবং কুসংস্কার প্রচারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। মিকাডোকে পূজা করার কোন যৌক্তিকতা আমাদের কাছে নেই বলে জাপানি শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্ভট দিকটি আমরা পরিষ্কার চোখে দেখতে পাই। আমাদের নিজস্ব জাতীয় কুসংস্কারগুলো আমাদের কাছে এত স্বাভাবিক এবং আবেগসহ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে জাপানিদের সম্বন্ধে অত সহজে আবিস্কার করা যায় না। একজন ভ্রমণকারী জাপানি আমাদের স্কুলে সমূহে মিকাডোর স্বর্গীয় উত্তারাধিকারিত্বের মতো বুদ্ধিবৃত্তি বিরোধ কুসংস্কারগুলো আবিস্কার করে যদি থিসিস লিখেন, আমার মতো তিনি ঠিক কাজই করবেন। যদি আমি একজন ছোট দোকানদারকে গিয়ে বলি, ”দেখো তোমার প্রতিযোগী রাস্তার ওপাশে। সে তোমার ব্যবস্থা কেড়ে নিচ্ছে, সুতরাং তোমার ব্যবস্থা বাঁচাতে চাইলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে তোমাকে গুলি করার আগে তুমি তাকে গুলী করে হত্যাকর “ তাহলে সে ক্ষুদ্র দোকানদার আমাকে পাগল ঠাওরাবে। সরকার যখন একই কথা জোড় দিয়ে ঢাক পিটিয়ে ঘোষণা করে তখন ছোট ছোট দোকানদারেরা পরম উৎসাহিত হয়ে ওঠে, কিন্তু পরে তারা দেখতে পায় তার ফলে তাদের ব্যবস্থা ক্ষগ্রিস্থ হয়েছে।
বিজ্ঞাপনদাতারা যে পদ্ধতি অনুসারে সাফল্য অর্জন করে একই পদ্ধতিতে সকল উন্নতদেশে, মতামত প্রচারে উপযুক্ত পন্থা বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে; বিশেষ করে এ পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক মতবাদ সৃষ্টি করা হয়।
হালে যে প্রচার প্রোপান্ডা চলছে তাতে দু’ধরনের আলাদা দোষ বর্তমান। এক ধরনের দোষ হলো, এর আবেদন সাধারনতঃ বিশ্বাসের অযৌক্তিক কারণে, সুচিন্তিত যুক্তির ধার দিয়েও ঘেঁষেনা। আরেক ধরণের দোষ হলো সম্পদ অথবা ক্ষমতার মাধ্যমে প্রেপাগান্ডা কতেক মানুষকে অন্যায় সুযোগ দান করে থাকে। প্রেপাগান্ডার বাক্য জাল যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রধান্য বেশি দেয় বলে আমি মনে করি। অনেক মানুষ যেমন ভাবে যুক্তি এবং আবেগের তেমন কোন সুনির্দিষ্ট ব্যবধান নেই। অধিকন্তু একজন চালাক মানুষ কোন সুযোগে প্রতিষ্ঠিত কোন কিছুর সমর্থনে প্রচুর ভালো যুক্তি তৈরি করে নিতে পারে। কোন বিষয়ের স্বপক্ষে-বিপক্ষে দুপক্ষেই ভালো যুক্তি থাকে। নির্দিষ্ট ভাবে বিষয়কে না ব্যক্ত করলে আইনমতে আপত্তি করা যেতে পারে, কিন্তু তার বিশেষ প্রয়োজন নেই। নাশপাতি, সাবান এসব শব্দ কিছু না বোঝালেও মানুষ ও সকল জিনিস ক্রয় করে। শ্রমিক পার্টি যদিও এ শব্দের মধ্যে কোনও আকর্ষণ নেই-তবু লক্ষ লক্ষ শ্রমিক শুধু নামের জন্য শ্রমিক পার্টির সমর্থনে ভোটদান করবে। দুপক্ষের বিরোধ নিস্পত্তি করার জন্যে আইন করে প্রখ্যাত নৈয়ায়িকদের একটি কমিটি যদি দোষগুণ বিচারার্থে নিয়োগ করা হয়, তাহলেও বর্তমান প্রোপাগাণ্ডার আসল দোষ দূর করা যাবে না। ধরা যাক দুদলের অবস্থা একই রকম আশাপ্রদ, একপক্ষের প্রোপাগাণ্ডার হাতে ব্যয় করার জন্য হয়েছে লক্ষ পাউণ্ড অন্য পক্ষের হাজার পাউণ্ড। গরিব পার্টির তুলনায় অপেক্ষাকৃত ধনী পার্টির বক্তব্য অধিক সংখ্যক মানুষ জানতে পারবে। সুতরাং নির্বাচনে ধনী পার্টিই জয়যুক্ত হবে। এরকম অবস্থা সাধারণতঃ যে সকল দেশে একপার্টি সরকার বর্তমান সে সকল দেশে হয়ে থাকে, তবে তার দরকার নেই। এমনিতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যে সকল সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে জয়লাভ করাবার জন্যে তাই যথেষ্ট, যদি না পরিস্থিতি ভিন্নরকম রূপ পরিগ্রহ করে।