চালাকি যখন প্রধান হয়ে উঠে, তখন আমাদের প্রবৃত্তির অবচেতনের চাইতে সচেতন স্তরের প্রভাবেই চালিত হয় বেশি। উদাহরণস্বরূপ ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করতে হলে যে প্রধান গুণগুলোর প্রয়োজন, তার কথাই ধরা যাক। নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে সবসময়ে স্বার্থপর বলে তা খুবই নমনীয় গুণ, তা সত্বেও মানুষকে তা গুরুতর অপরাধ থেকে বিরত রাখবার জন্যে যথেষ্ট। জার্মানদের যদি এ গুণটি থাকত তাহলে তারা সীমাহীন সাবমেরিন অভিযান করত না। ফরাসিদের এ গুণটি থাকলে তারা রহুরে যেমনটি করেছিল। তেমন আচরণ করত না। নেপোলিয়ন এ গুনের অধিকারী হলে এ্যামিয়েনের সন্ধির পর আবার যুদ্ধ করতে যেতেন না। যেখানে মানুষ তাদের স্বার্থ কোথায় বোঝে না, সেখানে সে পথকে তারা সত্য বলে গ্রহণ করে, ভ্রান্ত হলেও তার বিরুদ্ধে আসল পথটি দেখিয়ে দেয়া যে আরো ক্ষতিকর তা নিয়ম হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সুতরাং মানুষের নিজের স্বার্থের কল্যাণের পক্ষে-যা মানুষকে বিচারশীল করে তোলে, তা কল্যাণকর। ভাগ্যের পথ প্রশস্ত করার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। তার কারণ নৈতিকভাবে তারা এমন কিছু করেছে, যা তারা নিজের স্বার্থের বিপরীত বলে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। উদাহরণস্বরূপ প্রাথমিক কোয়েকারদের সময়ে কিছু সংখ্যক দোকানদার তাদের যে পরিমাণ দাবি তার চাইতে বেশি না-চাওয়ার নীতি গ্রহণ করে। অন্যান্য দোকানদারের মতো দরাদরি না করে সকলে একদরে মাল বিক্রয় করতে থাকেন। তারা এ নীতি গ্রহণ করেছিলেন, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল যা ন্যায্য দাবী, তার চাইতে বেশি চাইতে গেলে মিথ্যা বলা হবে। কিন্তু গ্রাহকদের সুবিধা এত বেড়ে গেল যে সকলে তাদের দোকান থেকে সওদা নিতে লাগল এবং তারা ধনী হয়ে গেলেন। (এটা আমি কোথায় পড়েছি তা ভুলে গেছি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কোন বিশ্বাসযোগ্য বইতেই পড়েছিলাম।) চালাকির থেকেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল বলা যেতে পারে, কিন্তু তাদের কেউ অতিরিক্ত চালাক ছিলেন না। সচেতন বিশ্বাস আমাদের যে পরিমাণ ভালো করে তার চেয়ে বেশি ঈর্ষাপরায়ণ করে তোলে। সুতরাং মানুষ যে সকল কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে সেগুলো নিজের স্বার্থের প্রতিকূলে। যে সকল মানুষ সচেতন বুদ্ধি দিয়ে যতটুকু সম্ভব আবেগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিন্তা করে, আসে তাদের কথা। তৃতীয়তঃ তাদের কথা আসে, যারা অপরের ধ্বংস সাধন করতে গিয়ে নিজেদেরকে ধ্বংস করে। ইউরোপের শতকরা ৯০ জন মানুষ এই শেষোক্ত শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত।
সে যাহোক আমি আমার আসল বক্তব্য বিষয় থেকে কিছুদূর সরে পড়েছি; কিন্তু অচেতন যুক্তি চালাকিকে সচেতন চিন্তা-বৈচিত্র থেকে আলাদা করার প্রয়োজন ছিল। মামুলি শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের সচেতন মনোবৃত্তির উপর কোন প্রতিক্রিয়া করতে পারে না, বর্তমান পদ্ধতির সাহায্যে চালাকি শিক্ষাও দেয়া যায় না। নৈতিকতা যেখানে স্বভাবের মধ্যে প্রোথিত নয়, সেক্ষেত্রে বর্তমান পদ্ধতির সাহায্যে শিক্ষা দেয়া যায় না। যারা সদাসর্বদা পরামর্শের আলোচনা করে থাকে তাদের মধ্যে কোথাও আমি কল্যাণকর প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই নি। সুতরাং আমাদের বর্তমান ধারা অনুসারে সকল প্রকারের স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টা বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থার মাধ্যমে সুসম্পন্ন করতে হবে। মানুষকে ধার্মিক অথবা চালাক করার কোন পন্থা আছে বলে আমাদের জানা নেই, কিন্তু কিছুদূর পর্যন্ত তাকে যুক্তিবাদীতা কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় তা আমরা জানি। প্রত্যেকটি বিষয়ে শিক্ষাবিভাগীয় কর্মকর্তারা যা করেন তার বিপরীতে কিছু করতে শিক্ষা দেয়া হলেই তা করা হবে। তারপরে আমরা তার সনালী গ্রন্থিগুলোর ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ অথবা বৃদ্ধি করে তার মধ্যে গুণের বিকাশ ঘটাতে পারি। কিন্তু বর্তমান মুহূর্তে গুণের সৃষ্টি করার চাইতে যুক্তিবাদীতার সৃষ্টি করা অধিকতর সহজ, সে যুক্তিবাদীতার অর্থ হলো, মনের এক প্রকার বৈজ্ঞানিক স্বভাব, যা আমাদের কাজের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।
(খ) মানুষের কাজ কতটুকু যুক্তিবাদী হতে পারে অথবা কতটুকু তার যুক্তিবাদী হওয়া উচিত, এখন আমি সে প্রশ্ন আলোচনা করছি। কতটুকু যুক্তিবাদী হওয়া উচিত, তাই প্রথম আলোচনা করা যাক। আমার মতে মনের নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যে বিচারবুদ্ধি সীমিত থাকা প্রয়োজন। বিচার-বুদ্ধির আক্রমণে জীবনের কতকগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধ্বংস হয়ে গেছে। লাইবনিজ বুড়ো বয়সে একবার খবরের কাগজের একে প্রতিনিধিকে বলেছিলেন যে তিনি পঞ্চাশ বছর বয়সে এক ভদ্রমহিলার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করতে কিছুদিন সময় চাইলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি বিবেচনা করে দেখে প্রস্তাব বাতিল করলেন। তার আচরণ যে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন তাতে সন্দেহ করবার কোন হেতু নেই। কিন্তু আমি প্রশংসা করি তা বলতে পারব না।
শেক্সপিয়র পাগল, প্রেমিক এবং কবিদেরকে এক সূত্রে সম্পূর্ণভাবে কাল্পনিক জীব বলে অভিহিত করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে উন্মাদদের বাদ দিয়ে পাগল এবং প্রেমিকদেরকে নেয়া যেতে পারে। আমি তার একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি।
ওল্ডভিক নাট্যমঞ্চে ১৯১৯ সালে ট্রোজান উ’ম্যান নাটকের অভিনয় দেখি। সে নাটকে অস্ট্রান্যাক্স দ্বিতীয় হেক্টর হয়ে যেতে পারে, সে আশঙ্কায় তাকে হত্যা করার একটি মর্মান্তিক দৃশ্য আছে। থিয়েটারে কোন দর্শকের চোখ শুষ্ক ছিল না। তবু দর্শকেরা যে গ্রিক নির্মমতা দেখেছিল, তা তাদের কাছে মোটেই বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। তা সত্বেও যে সব লোক থিয়েটারে কেঁদেছিল, সে মুহূর্তে এমন এক হৃদয়হীনতাকে প্রত্যক্ষ করেছিল, যা ইউরিপিডিসের কল্পনায় অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। যা জার্মানিকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এ সকল বিচ্ছিন্নকরণের ফলে অসংখ্য শিশুর যে মৃত্যু হয়েছে, তাতো সকলের জানা কথা। কিন্তু তারা অনুভব করেছিল তার ফলে শত্রুদেশের জনসংখ্যা হ্রাস পাবে। তা তাদের পিতৃপুরুষের গর্ব ধ্বংসকারী অস্ট্রান্যাক্সকে ধ্বংস করার মতো। ইউরিপিডিস দর্শকদের কল্পনায় প্রেমিককে জাগিয়েছিলেন কিন্তু তাদের কল্পনা থেকে প্রেমিক কবির স্মৃতি থিয়েটার হলের দরজাতেই মুছে গিয়েছিল। উন্মাদেরা (নরহত্যার রোগে যারা ভুগছে) যে সকল মানুষ নিজেদেরকে দয়ালু এবং ধার্মিক মনে করে সে সকল নরনারীর রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত করেছিল।