প্রাচ্যদেশে বাস করলে সাদা মানুষদের চরিত্র বোধহয় প্রাচ্যের ক্ষতিকর প্রভাবে প্রভাবিত হয়। কিন্তু চীন সম্বন্ধে জানার পর আমি অবশ্যই বলব যে, অলসতা মানুষের শ্রেষ্ঠতম গুণসমূহের একটি, যা মানুষকে সমষ্টিগত জীবনে অভ্যস্ত করে তোলে। আমরা অত্যুৎসাহী হয়ে কিছু অর্জন করতে পারি, কিন্তু প্রশ্ন করা যেতে পারে-যা আমরা অর্জন করি তা সত্যিকারের কোন মূল্য বহন করে কিনা। আমরা উৎপাদনব্যবস্থার অত্যাশ্চর্য পরিবর্তন সাধন করেছি যার অংশবিশেষ জাহাজ, মোটরগাড়ি টেলিফোন এবং সৌখিনভাবে বেঁচে থাকার বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন করেছি। আমাদের নিখুঁত উৎপাদনব্যবস্থার অপরাপর হুনুর হেকমত আমরা বন্দুক, বিষাক্ত গ্যাস, উড়োজাহাজ এবং পরস্পরকে পাইকারি হারে হত্যার অভিপ্রায়ে নিয়োজিত করেছি। আমাদের প্রথম শ্রেণীর শাসনব্যবস্থা এবং ট্যাক্স আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে, যার অংশবিশেষ শিক্ষা, স্বাস্থ্যরক্ষা প্রভৃতি হিতকর কাজে ব্যয়িত হয়, কিন্তু বাকিটুকু যুদ্ধের জন্য ব্যয় করা হয়। বর্তমান ইংল্যাণ্ডের জাতীয় রাজস্বের বেশীর ভাগ যুদ্ধের ঘাটতি পূরণের অথবা ভাবী যুদ্ধের সম্ভাবনায় ব্যয়িত হয়। তাছাড়া বাদবাকি যা থাকে তাই জনহিতকর কাজে ব্যয় করা হয়। মহাদেশের অধিকাংশ দেশে লোকহিতকর কাজে ব্যয়িত অর্থের অনুপাত অনেক ক্ষেত্রে ইংল্যাণ্ডের চেয়েও কম। আমাদের পুলিশব্যবস্থার যোগ্যতার তুলনা নেই কোথাও। তার অংশবিশেষ অপরাধ অনুসন্ধান এবং অপরাধ বন্ধ করার কাজে তৎপর; বাকি অংশ কারো কোন নতুন গঠনমূলক রাজনৈতিক আদর্শ থাকলে তাকে কারারুদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত। সাম্প্রতিক কাল ছাড়া চীনদেশে এসবের কিছুই ছিলনা। তাদের কারখানা তাদের জন্য মোটর গাড়ি এবং বোমা তৈরি করতে পারত না রাষ্ট্র নিজস্ব নাগরিককে পরদেশের নাগরিক হত্যার জন্য শিক্ষিত করে তুলতে অক্ষম ছিল। তাদের পুলিশে বলশেভিক অথবা ডাকাত পাকরাও করার কাজে সম্পূর্ণরূপে অযোগ্য ছিল! এর ফল হলো চীনদেশে শ্বেতাঙ্গ মানুষের দেশসমূহের তুলনায় ঢের বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত এবং অল্প সংখ্যক মানুষ ছাড়া প্রায় দারিদ্র লাঞ্ছিত মানুষও একধরনের পরিব্যাপ্ত সুখের আস্বাদ পেত।
গড়পড়তা চীনাদেশের সঙ্গে গড়পড়তা পশ্চিমাদের আসল দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে দু’জাতীয় উল্লেখ্য পার্থক্য বর্তমান। প্রথমতঃ চীনারা কোন লোকহিতকর উদ্দেশ্য সাধিত না হওয়া পর্যন্ত কোন কাজকে প্রশংসা করেনা। দ্বিতীয়তঃ তারা মনে করে নিজস্ব প্রবৃত্তি দমন করা এবং অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর মধ্যে নৈতিকতার মৌল পরিচয় নিহিত নয়। এ দু’রকমের পার্থক্যের মধ্যে প্রথমটা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে দ্বিতীয় পার্থক্যটা সম্পর্কে আলোচনা করাটাও সমানভাবে প্রয়োজনীয়। খ্যাতনামা চীনা পণ্ডিত অধ্যাপক গাইলস তার কনফুসিয়াস এবং তার বিরুদ্ধবাদীদের উপর গিফোর্ড বক্তৃতার উপসংহারে বলেছেন, আদি পাপের নীতিই (The doctrine of original sin) চিনদেশে খ্রিস্টান প্রচারক মণ্ডলীর প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দূর প্রাচ্যে এখনো গোড়া প্রচারকেরা প্রচার করে তাকে যে আমরা সকলে পাপী হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেছি, যে পাপের কারণে আমাদেরকে চিরন্তন শাস্তি ভোগের অধিকারী হতে হবে। যদি শ্বেতাঙ্গ মানুষদের জন্যও এ নীতি কার্যকরী হতো তাহলে সম্ভবতঃ চীনাদের খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণে কোন আপত্তি থাকত না। কিন্তু যখন তাদেরকে বলা হয় তাদের পিতামাতা এবং প্রপিতামহেরা দোজখের আগুনে জ্বলছে। তখন তারা ক্ষিপ্ত না হয়ে পারে না। কনফুসিয়াস শিক্ষা দিয়েছেন মানুষ পবিত্র হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে। একমাত্র খারাপ দৃষ্টান্তের শক্তি অথবা দুর্নীতিপূর্ণ ব্যবহার তাদেরকে কুপথে নিয়ে যায়। পাশ্চাত্যের ঐতিহ্যিক গোঁড়ামির সঙ্গে এ-পার্থক্য চীনাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
আমাদের মধ্যে যাদেরকে নৈতিকতার উজ্জ্বল নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়, তারা জীবনের ছোটোখাটো আনন্দ ভুলে গিয়ে অন্যের আনন্দ নিয়ে অধিকতর মাথা ঘামান। আমাদের মধ্যে গুণ সম্পর্কে যে ক্রিয়াশীল ধারণা রয়েছে তা হলো কোন মানুষ যদি নিজেকে খুব বেশি সংখ্যক মানুষের ক্ষতির কারণ না হতে পারে, তাহলে তাকে আমরা খুব বেশি ভালো মানুষ বলে স্বীকৃতি দেইনা। পাপের ধারণা থেকে আমাদের মধ্যে এ মনোভাবের উদয় হয়েছে। তার ফলে শুধু অন্যের স্বধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে হয় না, কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়, যেহেতু চিরাচরিত পদ্ধতিতে জীবনধারণ করা অধিকাংশলোকের পক্ষে অসম্ভব। চীনের ব্যাপারে কিন্তু আলাদা। নৈতিক ধারণাগুলো না-বাচক নয়, হাঁ বাচক। সেখানে এটা আশা করা হয়ে থাকে যে একজন মানুষ তার মা বাপের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সন্তান সন্তুতির প্রতি স্নেহশীল, দরিদ্র প্রতিবেশীর প্রতি দয়ার্দ্র এবং সকলের প্রতি দ্র হবে। এ সকল খুব কষ্টকর কর্তব্য নয়, আসলে বেশি কর্যকরী।
আদিপাপের বোধ না থাকার আরেকটা সুফল হলো মানুষেরা তাদের বিভিন্নতা যুক্তির আলোকে যাচিয়ে নিতে অধিকতর আগ্রহশীল হয়ে উঠতে পারে প্রতীচ্যের তুলনায়। আমাদের মধ্যে মতের বিভিন্নতা খুব শিগগির নীতির প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। পরস্পর পরস্পরকে দোষী সাব্যস্ত করে আমাদের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি হয় যার বাস্তব সমাধান খুঁজতে হলে শক্তি প্রয়োগ ছাড়া আর কোন খোলা পথ থাকেনা। চীনে যদিও অতীতে সামরিক নায়ক ছিল কিন্তু তাদের কেউ অত সাংঘাতিক মনে করত না এমনকি তাদের নিজস্ব সৈনিকরাও না। তারা যুদ্ধ করত, কিন্তু সে সব যুদ্ধে বলতে গেলে একেবারে রক্তপাত হতো না। পাশ্চাত্যের কঠোর শক্তির সংঘাতের যে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে সে তুলনায় তারা অল্পস্বল্প ক্ষতি করত। সৈন্যাধ্যক্ষের অবর্তমানেও অধিকাংশ নাগরিক বেসামরিক পদ্ধতিতে আপন আপন কাজকর্ম চালিয়ে যেত। সাধারণতঃ ঝগড়া বিবাদ তৃতীয় ব্যক্তির বন্ধুত্বপূর্ণ সালিশের মাধ্যমে নিস্পন্ন করা যেত। আপোষে মিটমাট করা ছিল চীনের নির্ধারিত নীতি, যদিও বিদেশীর হাসি উদ্রেক করে, তবু এ এমন একটা পদ্ধতি যা সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে আমাদের এত ভাঙন সৃষ্টি করেনা।