নৈতিক শিক্ষকের পক্ষে যা অবশ্য করণীয়, তিনি কর্তব্য নীতি এবং ধর্ম সম্পর্কে প্রচুর বলেছেন। কিন্তু মানুষের বিরুদ্ধেও স্বাভাবিক স্নেহ প্রদর্শনের বিপক্ষে কোন কিছুর সীমারেখা নির্দেশ করে দেননি। নিম্নোক্ত কথোপকথনের মধ্যে তার যথাযথ প্রমাণ পাওয়া যাবে।
শিল্প অঞ্চলের সামন্ত কনফুসিয়াসকে সম্বোধন করে বললেন, আমাদের দেশে একজন সাহসী মানুষ আছেন। তার বাবা একটি ভেড়া চুরি করেছিলেন, তিনি বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করেন। কনফুসিয়াস বললেন, আমাদের দেশের সাহসিকতার ধরন ভিন্নতর। পিতা পুত্রের দোষ ঢেকে রাখে এবং পুত্র পিতার গোপনীয়তা রক্ষা করে। এ-ধরনের আচরণের মধ্যেই সত্যিকারের সাহসিকতার সন্ধান মিলবে।
কনফুসিয়াস ছিলেন সব ব্যাপারে, এমনকি নীতির দিক দিয়েও সহনশীল। খারাপ ব্যবহারের বদলে আমাদের ভালো ব্যবহার দেখানো উচিত, একথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। তাকে এক সময় প্রশ্ন করা হয়েছিল, “খারাপ ব্যবহারের বদলে ভালো ব্যবহার প্রদর্শনের নীতি সম্পর্কে আপনার কী অভিমত”? তিনি জবাবে বলেছিলেন, “তাহলে ভালো ব্যবহারের বদলে কী রকম ব্যবহার করা হবে? বরঞ্চ তোমরা অবিচারের বদলে সুবিচার এবং ভালোর বদলে ভালো ব্যবহার করবে।” তার সময়ে তাওপন্থিরা মন্দের বদলে সুবিচার এবং ভালো ব্যবহার এবং প্রদর্শনের শিক্ষা প্রচার করতেন যা কনফুসিয়াসের শিক্ষার চেয়ে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে অধিকতর সাদৃশ্যাত্মক। তাওবাদের প্রতিষ্ঠাতা লাওসে (অনুমান করা হয়ে থাকে তিনি কনফুসিয়াসের সমসাময়িক ছিলেন) বলেন, “আমি ভালো ব্যবহার করবো, যারা ভালো নয় তাদের সঙ্গেও আমি ভালো ব্যবহার করব, যেন আমি তাদেরকেও ভালো করতে পারি। অবিশ্বাসীদের সঙ্গেও আমি বিশ্বাস রক্ষা করব, যেন আমি তাদের বিশ্বাসী করতে তুলতে পারি। যদি একজন মানুষ খারাপও হয়ে থাকে তাকে পরিত্যাগ করা কি এমন ভালো কাজ। আঘাত পেলে হাসিমুখে সহ্য করব।” লাওসের কিছু কথা আশ্চর্যভাবে পর্বত থেকে প্রদত্ত বক্তৃতার এত। যেমন তিনি বলেছেন,”যে ব্যক্তি বিনয়কে রক্ষা করে, সে অক্ষতভাবে রক্ষিত হবে। যে (শ্রদ্ধায়) নুয়ে পড়তে জানে তাকে সোজা করা হবে। যে খালি আছে তাকে ভর্তি করা হবে। যার অল্প আছে সে সফলতা অর্জন করবে এবং যার বেশি আছে সে কুপথে গমন করবে।”
চীনের বৈশিষ্ট্য অনুসারে লাওসে নয়, কনফুসিয় চীনের জাতীয় ঋষি বলে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। যাদুমন্ত্র হিসাবে অশিক্ষিত মানুষদের মধ্যে তাওবাদ স্থায়িত্ব লাভ করেছিল। তার নীতিসমূহ সাম্রাজ্য শাসনকারী বস্তুতান্ত্রিক রাজপুরুষদের কাছে কাল্পনিক বলে প্রতিভাত হয়েছিল। পক্ষান্তরে কনফুসিয়াসের নীতিগুলো বিবাদ বিসংবাদ এড়িয়ে যাবার এত অধিকতর নির্ধারিত এবং স্থিরিকৃত ছিল। লাওসে নিষ্ক্রিয়তার নীতিকেই প্রচার করেছেন। তিনি বলেছেন, “ঘটনাপ্রবাহের সুযোগ গ্রহণ করে যারা সাম্রাজ্য দখল করে তারা সব সময়ে সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য নিজেদের অসমর্থন করে। কিন্তু চীনের রাজপুরুষবৃন্দ স্বভাবতঃই কনফুসিয়াসের আত্মনিয়ন্ত্রণ, উপচিকীর্ষা এবং সে সঙ্গে ভদ্রতার মিশ্রিত নীতির অনুসরণে কল্যাণধর্মী সরকার যে ভালো কাজ করতে পারে তার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রয়োগ করতেন।
শ্বেতাঙ্গ জাতিসমূহের ন্যায় চীনা জাতি কখনো থিয়োরিতে এক নীতি ব্যবহারিক জীবনে আরেক নীতিকে গ্রহণ করেনি। আমি এ কথার মানে এ বলতে চাই না যে তারা সবসময়ে থিয়োরি অনুসারে জীবন ধারণ করেছে। তা না-হলেও তাদের লক্ষ্য ছিল সে দিকে, থিয়োরিকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা তারা করে থাকে। অন্যদিকে দেখতে গেলে খ্রিস্টিয় নীতিশাস্ত্রের অধিক সংখ্যক নীতিই এ মন্দ জগতের জন্য অত্যন্ত উপকারী বলে সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেছে।
মোদ্দা কথায় আমাদের মধ্যে পাশাপাশি দু’রকমের নীতিবোধ বর্তমান। একরকম হলো, যা আমরা প্রচার করি কিন্তু পালন করি না। অন্যটি আমরা দৈনন্দিন জীবনে মেনে চলি কিন্তু কদাচিৎ প্রচার করি। খ্রিষ্টধর্ম ও ধর্ম ছাড়া অন্যান্য এশীয় ধর্মের মতো ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ এবং পারলৌকিক বিষয়ে প্রথম দিকের শতাব্দীগুলোকে তারা সর্বাধিক গুরুত্ব দান করত। অন্য জগতের প্রতি গুরুত্ব দান করাই হলো এশীয় মরমীদের বৈশিষ্ট্য। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বাধ্যবাধকতার মূলনীতি বুদ্ধি গ্রাহ্যতা অর্জন করেছিল। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্ম যখন ইউরোপের অত্যুৎসাহী রাজপুরুষদের আনুষ্ঠানিক ধর্ম হিসেবে বর্ধিত হলো, তখন তারা এর কতকগুলো নীতি আক্ষরিক অর্থে বর্জন করার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করল, পক্ষান্তরে অন্য কতেক নীতি যেমন ‘সিজারের প্রাপ্য সিজারকে দাও’ ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। আমাদের প্রতিযোগীতামূলক শিল্পায়নের যুগে বাধা না দেয়ার সামান্যতম আবেদনকেও ঘৃণা করা হয় এবং মানুষকে জীবিকা বিজয়ে সমর্থ বলে ধরে নেয়া যায়। বাস্তবে আমাদের কার্যকরী নৈতিকতাবোধ হলো সংগ্রাম করে যে পরিমাণ বাস্তব সাফল্য অর্জন করা যায় তারই নিরিখে ব্যক্তিবিশেষ এবং জাতিবিশেষের পরিচয়। এর বাইরে কোমল কিছু থাকলে তা আমাদের কাছে। বোকামি বলে মনে হয়।
চীনারা আমাদের থিয়োরিগত অথবা ব্যবহারিক কোন নৈতিকতাকে গ্রহণ করেনি। চীনারা থিয়োরিগতভাবে বিশ্বাস করে যে এমনও সময় আসে যখন যুদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত, কিন্তু বাস্তবে সে সময় আসে কদাচিৎ। আর আমরা থিয়োরিতে বিশ্বাস করি, কোন অবস্থাতেই যুদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত নয়, কিন্তু বাস্তবে প্রায়ই যুদ্ধে লিপ্ত থাকি। চীনারা মাঝে মাঝে যুদ্ধ করে, তবে যুদ্ধা জাতি তারা নয়, যুদ্ধে জয়লাভ অথবা ব্যবসায়ে সফলতাকে খুব প্রশংসার চোখে তারা দেখে না। ঐতিহ্যগতভাবে জ্ঞানকে তারা সব কিছুর চেয়ে বেশি প্রশংসা করে। তারপরে প্রায়শঃ এর সঙ্গে সঙ্গে তারা নাগরিকতা এবং ভদ্রতাকে প্রশংসার চোখে দেখে। যুগযুগ আগে চীনদেশে শাসনবিভাগীয় পদগুলো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করেই প্রদান করা হতো। দু’হাজার বছর ধরে চীনদেশে একমাত্র কনফুসিয়াসের পরিবার, যার প্রধান ছিল একজন সামন্ত তিনি ব্যতীত আর কোন বংশগত আভিজাত্যের রেওয়াজ ছিল না। সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপে ক্ষমতাবান সামন্তদেরকে যেরকম শ্রদ্ধা সম্মান দেখানো হতো, চীনদেশ জ্ঞানবানদের একই রকম শ্রদ্ধা সম্মান নিজস্ব পদ্ধতিতে নিবেদন করত। প্রাচীন জ্ঞান যার পরিধি খুবই সীমিত শুধুমাত্র অসমালোচিত চীনের ধর্মীয় জ্ঞান এবং স্বীকৃতি প্রাপ্ত ভাষ্যকারদের টীকা-ভাষ্যের মধ্যেই সীমবিদ্ধ ছিল। পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে এসে ভূগোল, অর্থনীতি, প্রাণীবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা শিক্ষা করছে চীনারা, যা বিগত যুগের নীতি শিক্ষার চেয়ে বাস্তব প্রয়োজন মিটাতে অনেক বেশি সক্ষম। নতুন চীনা-তার মানে যারা ইউরোপিয় পদ্ধতিতে শিক্ষা দীক্ষা পেয়েছে, আধুনিক প্রয়োজনের সম্পর্কে সবিশেষ ওয়াকেবহাল বোধ হয়। তাদের প্রচীন ঐতিহ্যের প্রতি তেমন বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ নেই। তারপরেও কিছু বাদ দিলে অত্যাধুনিকেরাও সহনশীলতা, ভদ্রতা এবং মেজাজের স্নিগ্ধতা রক্ষা করে চলছে। পাশ্চাত্য এবং জাপানিরা তাদের যে হারে প্রভাবিত করেছে, তাতে করে এ বৈশিষ্টগুলোও আগামী কয়েক দশক পর্যন্ত অক্ষত অটুট রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ। চীনা এবং আমাদের মধ্যে যে পার্থক্য তা যদি একটি মাত্র বাক্যের মধ্যে আমাকে বলতে হয়, তাহলে আমি বলবো, তারা প্রধানতঃ আনন্দের প্রতি আগ্রহশীল আর আমরা মুখ্যতঃ ক্ষমতার প্রতি লালায়িত। আমরা আমাদের সমধর্মীমানুষের উপর ক্ষমতা বিস্তার করতে চাই, ক্ষমতাবলে প্রকৃতিকে দাস করতে চাই। মানুষের উপর ক্ষমতার শাসন চালু রাখার জন্যে আমরা বিজ্ঞানকে উন্নত করেছি। এসব ব্যবহারে চীনারা ভয়ঙ্কর অলস, এবং অত্যধিক খোসমেজাজী। রাশিয়ানরা যে অর্থে অলস চীনারা সে অর্থে অলস নয়। তারা জীবন ধারণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। শ্রমিক মালিকদের চোখে তারা কঠোর পরিশ্রমী। আমেরিকান কিংবা পশ্চিম ইউরোপের লোকেরা যে অর্থে পরিশ্রমী তারা সে অর্থে পরিশ্রমী নয়। কাজ না করলে মেজাজের প্রফুল্লতা হারিয়ে ফেলবে বলেই তারা কাজ করে, অনাবশ্যক তাড়াহুড়া পছন্দ করে না। জীবন ধারণ করার মতো অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা তাদের থাকলে তারা তার উপর নির্ভর করে। সঞ্চয়ের জন্য তারা কঠোর পরিশ্রম করে না। অবসর সময়ে চিত্তবিনোদনের জন্য তাদের অবিশ্বাস্য ক্ষমতা রয়েছে। থিয়েটারে গিয়ে, চা খেতে খেতে গল্প-গুজব করে, প্রাচীন চীনা শিল্পকলার প্রশংসা করে অথবা সুন্দর সুন্দর দৃশ্যাবলীর উপর দিয়ে পায়চারী করতে করতে তারা সময় কাটায়। আমদের চিন্তাধারা অনুসারে জীবনকে এভাবে খরচ করার মধ্যে একরকমের অহেতুক নিশ্চেষ্ট শিষ্টতার সন্ধান পাওয়া যাবে। যে লোক প্রত্যেকদিন ঠিক সময়ে তার অফিসে যায়, সেখানে যা করে সব ক্ষতিকর হলেও আমরা তাকে শ্রদ্ধান্বিত দৃষ্টিতে দেখে থাকি।