কিন্তু এখন ন্যায়শাস্ত্র অনুমান করা থেকে বিরত হওয়ার পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে; যেহেতু এটা দেখা গেছে যে, যে সকল অনুমানের প্রতি আমরা স্বভাবতইঃ অনুরক্ত সেগুলো ধোপে টিকার মতো নয়। সুতরাং উপসংহারে আমি বলতে চাই যে, স্কুলে এমনভাবে ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষা দেয়া উচিত, যাতে করে মানুষকে অনুমান না করতে শিক্ষা দেয়া হয়, যদি তারা অনুমান করে, তাহলে তারা ভুল অনুমান করবে।
০৮. সুখের আদর্শ ও প্রাচ্য-প্রতীচ্য
ওয়েলস এর ‘টাইম মেশিন’ এর কথা সকলেই জানে-যার সাহায্যে ঐ যন্ত্রের অধিকারী ইচ্ছে করলে সময়ের সামনে পিছে ভ্রমণ করে অতীত ভবিষ্যত সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে ভ্রমণ করেও ওয়েলস সাহেবের উদ্ভাবিত যে যান্ত্রিক পদ্ধতি তার অনেকগুলো সুফল ভোগ করা যায়, একথা মানুষ সকল সময় হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। একজন ইউরোপিয় নিউইয়র্কে গিয়ে অর্থনৈতিক বিপত্তি এড়িয়ে গেলে ইউরোপের যে সম্ভাব্য পরিণতি তা দেখতে পাবেন। এশিয়াতে গেলে তিনি ইউরোপের অতিভ্রান্ত অতীতকেই দেখতে পাবেন। আমাকে বলা হয়েছে ভারতে তিনি প্রাচীন যুগ এবং চীন দেশে অষ্টাদশ শতাব্দীর দেখা পাবেন। জর্জ ওয়াশিংটন যদি আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন তাহলে তার সৃষ্ট দেশটি তাকে এক্কেবারে হতবুদ্ধি বানিয়ে দেবে। ইংল্যাণ্ডকে দেখে তিনি অপেক্ষাকৃত কম আশ্চর্যান্বিত হবেন, ফ্রান্সকে দেখে আরো কম। চীনে না-পৌঁছা পর্যন্ত তিনি পরিপূর্ণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন না। একমাত্র চীনেই তার প্রেতাত্মা যে সব মানুষের দেখা পাবে যারা জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের আদর্শে এখনো বিশ্বাসী। আমেরিকানরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যে সকল আদর্শ আকড়ে ধরেছিল, চীনারাও সে আদর্শসমূহকে আকড়ে ধরে আছে। আমার ধারণা চীনা প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট তিনি না হওয়া পর্যন্ত চীনারা সে অধিকার অর্জন করতে পারবে না।
পশ্চিমা সভ্যতাকে উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা, রাশিয়াসহ ইউরোপ এবং বৃটিশ শায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলগুলো বরণ করে নিয়েছে। এ ব্যাপারে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র কাফেলার পুরোভাগে রয়েছে। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে যত রকমের পার্থক্য, তার সবগুলো আমেরিকাতেই সর্বাপেক্ষা সুস্পষ্ট এবং চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয়েছে। আমরা কোনরকমের সন্দেহ ব্যতিরেকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে প্রগতিকে মেনে নিয়েছি, আরো মেনে নিয়েছি গত একশ বছরের মধ্যে যেসকল পরিবর্তন হয়েছে, ভালোর জন্যই হয়েছে, অধিকতর অনির্দিষ্ট পরিবর্তন অবশ্যই অধিকতর সুফল প্রসব করবে। গত প্রথম মহাযুদ্ধ এবং মহাযুদ্ধের আনুষঙ্গিক ফলাফল ইউরোপ মহাদেশের মানুষের এ নির্ভরশীল বিশ্বাসে প্রচণ্ডতর আঘাত করেছে। সম্প্রতি ইউরোপের মানুষ ১৯১৪ সনের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ইতিহাসে পরবর্তী শতাব্দী ধরে পূনরায় ফিরে পাওয়া অসম্ভব জ্ঞান করে স্বর্ণযুগ হিসেবে ভাবতে আরম্ভ করেছে। ইংল্যান্ডে আশাবাদীতা ভয়ংকরভাবে মার খায়নি। আমেরিকাতে আঁচড়ও লাগেনি। আমাদের মধ্যে যারা প্রগতিকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ভাবতে অভ্যস্ত তাদের উচিত বিশেষ করে চীনের মতো একটি দেশে ভ্রমণ করা, যারা আমাদের থেকে তুলনামূলকভাবে একশ পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে আছে। তাদের দেখে বিচার করা, যে সকল পরিবর্তন আমাদের দেশে ঘটেছে তাতে করে পৃথিবীর সত্যিকার কোন উন্নতি সাধিত হয়েছে কিনা।
সকলেই জানে কনফুসিয়াসের শিক্ষার উপর চীনা সভ্যতার বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত। তিনি যিশুখ্রিস্টের জন্মের পাঁচ হাজার বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গ্রিক রোমানরা যেমন ভাবতো মানব-সমাজ স্বভাবতঃই প্রগতিশীল তিনি তা ভাবতেন না। পক্ষান্তরে তার ধারণা সুদূর অতীতে শাসনকর্তারা ছিলেন জ্ঞানী এবং মানুষ এমন এক পর্যায়ের সুখী ছিল যা শ্রদ্ধাহীন বর্তমানকে প্রসংশা করলেও সে সুখ ভোগ করতে সমর্থ হবে না। আসলে এটা এক প্রকারের মোহ। কিন্তু এর প্রত্যক্ষ ফল হলো দূর অতীতের অন্যান্য শিক্ষকের মতো কনফুসিয়াসও সব সময় নতুন সাফল্যের পানে ধাবিত না হয়ে নৈতিকতার উৎকর্ষের উপর একটি স্থায়ী সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন। এতে তিনি অন্যান্যের চেয়ে অধিক সাফল্য লাভ করেছেন। তার ব্যক্তিত্ব চীন সভ্যতার উপর এমনভাবে ছাপ মেরেছে যা তার কাল থেকে আমাদের কাল পর্যন্ত প্রসারিত সময়ে অটুটভাবে সংরক্ষিত আছে। তার জীবদ্দশায়, চীনারা বর্তমান চীনের সামান্য ভূখণ্ড মাত্র দখল করেছিলেন এবং কয়েকটা বিবদমান রাষ্ট্রের মধ্যে তা বিভক্ত ছিল। পরবর্তী তিনশ বছরের মধ্যে বর্তমান চীনের সবটুকু তারা দখল করে নিলো এবং আয়তন বিস্তৃতির দিক দিয়ে এমন এক বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করল গত পঞ্চাশ বছর বাদ দিলে বাদবাকি সময়ের মধ্যে তার কোন জুড়ি ছিল না। বর্বর জাতির আক্রমণ, মোঙ্গল এবং মানচু সাম্রাজ্যের মধ্যে ক্ষণস্থায়ী এবং দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ ও গৃহযুদ্ধ সত্ত্বেও কনফুসিয় শিল্পকলা এবং সাহিত্য সমৃদ্ধ দ্র জীবন যাপন পদ্ধতি অক্ষতভাবেই বর্তমান ছিল। একমাত্র আমাদের কালে পশ্চিমা এবং পশ্চিমাদের অনুকারক জাপানিদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে এ জীবন যাপন ব্যবস্থায় ভাঙন ধরতে আরম্ভ করেছে।
যে জীবন যাপন পদ্ধতি এত দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকবার অসম্ভব শক্তি রয়েছে তার মধ্যে অবশ্যই এমন কোন উৎকর্ষ আছে যা আমাদের শ্রদ্ধা এবং সুবিবেচনার দাবি রাখে। ধর্ম বলতে আক্ষরিক অর্থে যা বুঝি কনফুসিয়াসের শিক্ষা সঠিক অর্থে তা নয়। যেহেতু এর সঙ্গে অতিলৌকিক অথবা কোন মরমি বিশ্বাস সম্পর্কশীল নয়। এ হচ্ছে খাঁটি নৈতিক একটা পদ্ধতি। কিন্তু এর নীতিমালা খ্রিস্টান ধর্মের অস্পষ্ট নীতিমালার মতো সাধারণ লোকের পক্ষে মেনে চলা মোটেই অসম্ভব নয়। সূক্ষ অর্থে। বলতে হলে কনফুসিয়াস যা শিক্ষা দিয়েছেন তা অষ্টাদশ শতাব্দীর সেকেলে মনোভাবসম্পন্ন ভদ্রলোকের আদর্শের এত অনেকটা। তার একটা বক্তব্যের মধ্যে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমি লায়নেল গিলস (Lionel giles) এর কনফুসিয়াসের বাণী থেকে উদ্ধৃত করছি। “সত্যিকারের ভদ্রলোক কখনো কলহপরায়ন হতে পারে না। একমাত্র বন্দুক ছোঁড়ার প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কোথাও বিবাদ বিসম্বাদ ঘটতে পারে না। সেখানেও তিনি স্থান বেছে দাঁড়াবার পূর্ব প্রতিদ্বন্দ্বীকে অভিবাদন করেন যাতে তিনি, প্রতিযোগিতার সময়েও সত্যিকারের ভদ্রলোক থাকতে পারেন।”