সন্দেহজনক সবকিছুকে সত্য বলে জোরালোভাবে বিশ্বাস করার চূড়ান্ত নজির হলো জাতীয়তাবাদ। আমার মনে হয় এখন একজন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস লেখক যে মতামত প্রদান করতে বাধ্য হবেন, যুদ্ধের সময়ে একই মন্তব্য করলে যুদ্ধলিপ্ত যে কোন দেশ তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে বাধ্য হতো। চীনদেশ ছাড়া আর কোন দেশ নেই, যে দেশের জনসাধারণ নিজেদের সম্বন্ধে সত্য কথা বললে সহ্য করে। সাধারণতঃ সত্যকে অপ্রিয় ভাবা হয়, কিন্তু যুদ্ধের সময়ে সত্য বলা ভয়ঙ্কর গর্হিত কাজ। বিপরীতধর্মী যে বিস্ফোরক বিশ্বাসের সৃষ্টি করা হয়েছে, এসকল বিশ্বাসের মূলে যে ভ্রান্তি ছাড়া কিছু নাই, তা তখনই ধরা পড়ে যখন দেখা যায় জাতীয়তাবাদীরা ছাড়া কেউ তাকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসের এ সমস্ত পদ্ধতির মধ্যে বিচার বুদ্ধির প্রয়োগকে আগেকার যুগে ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিচার বুদ্ধির প্রয়োগের মতো মন্দ ভেবে থাকে মানুষ। সংশয়বাদ এ সকল ব্যাপারে কেননা মন্দ হবে, এ ব্যাপারে যদি চ্যালেঞ্জ করা হয়, তারা বলে যে পৌরাণিক বিশ্বাস যুদ্ধজয়ে সাহায্য করে অথচ একটা জাতি হত্যা করার চাইতে হত হয় বেশি। সমস্ত বিদেশীদের নিন্দা করে নিজেদের মুখরক্ষা করার মধ্যে যে নিন্দনীয় কিছু আছে তা একমাত্র কোয়েকার (Quaker) শ্রেণী ছাড়া পেশাদার নীতিবাগিশদের মধ্যে তার কোন সমর্থন পাওয়া যায় না। যখন বলা হয় যে একটি যুক্তিবাদী জাতিকে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ার পন্থা আবিষ্কার করতে হবে, তাহলে উত্তরে জুটবে তিরস্কার।
যুক্তিবাদী সংশয়বাদের প্রসারের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে? আবেগ থেকেই মানুষের কর্মের উৎপত্তি এবং তার ফলে কতেক অন্ধবিশ্বাস জন্মলাভ করে। মনঃসমীক্ষা স্বীকৃত এবং অস্বীকৃত উন্মাদের মধ্যে এর বহিঃপ্রকাশ নিরীক্ষণ করেছে। যে মানুষ লাঞ্ছিত হয়েছে, অনেক সময় একটা থিয়োরি আবিস্কার করে যে সে ইংল্যাণ্ডের রাজাধিরাজ এবং তার সপক্ষে এমন সব যুক্তি ও ব্যাখ্যা খাড়া করে তোলে যে মর্যাদা তার পাওয়া উচিত সে ততটুকু মর্যাদা পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে তার এমন এক ধরণের চিত্তবিভ্রম ঘটেছে, যা তার প্রতিবেশীরা সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করে দেখেন, সেজন্য তারা তাকে তালাবদ্ধ করে রাখেন। যদি শুধু নিজের মহত্ব না বাড়িয়ে জাতি, ধর্ম ঐতিহ্য ইত্যাদির মহত্ব বর্ধিত করে তাহলে সে তার আশপাশের মানুষের সমর্থন অর্জন করে এবং রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় নেতা বনে যায়। যদিও নিরপেক্ষ বিদেশীর কাছে তার মতামত পাগলাগারদের রোগির মতো মনে হয়, তাতে কিছু আসে যায় না। এভাবেই সমষ্টিগত পাগলামির স্বভাব গড়ে ওঠে যা ব্যক্তি-পাগলামির সমস্ত নিয়ম-কানুন মেনে চলে। সকলেই জানে যে, লোক নিজেকে ইংল্যাণ্ডের রাজা মনে করে, তার মতো উন্মাদের সঙ্গে বিবাদ করা অর্থহীন, কিন্তু তাকে বিচ্ছিন্ন করে অতিরিক্ত শক্তিশালী করা হয়। সমগ্র জাতি যখন একটা উন্মাদ স্বপ্নে মেতে ওঠে, তখন জাতির ক্রোধ অনেকটা পাগলে ক্রোধের মতো বাধা পেলে সহস্র শিখায় জ্বলে উঠে। কোনরকমের প্ররোচনাই তাকে যুক্তির কাছে নতি স্বীকার করাতে পারে না।
বুদ্ধিবাদী উপাদান মানুষের আচরণে কী কী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে, সে সম্বন্ধে মনস্তত্ববিদদের মধ্যে প্রচুর মতভেদ রয়েছে। তার মধ্যে দু’রকমের মতভেদই প্রধান। (১) কাজের কারণ হিসেবে ধরে নিয়ে বিশ্বাসগুলো কতদূর ক্রিয়াশীল? (২) বিশ্বাসগুলো কতোদূর যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ থেকে উদ্ভূত অথবা কতোদূর পরিমাণ তা সম্ভব এ দু’প্রশ্নেই মনস্তত্ববিদেরা সাধারণ মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক উপাদানকে যতটুকু স্থান দিয়ে থাকে, তার চাইতে যে কম প্রয়োজনীয় সে সম্বন্ধে একমত। কিন্তু সাধারণ ঐক্যের অভ্যন্তরে লক্ষণীয় অনেকগুলো। বৈপরীত্য রয়ে গেছে। আমরা তার মধ্যে পরপর দু’টোকেই তুলে ধরছি। (১) কাজের কারণ হিসেবে বিশ্বাসগুলো কতোদূর ক্রিয়াশীল? থিয়োরিগতভাবে প্রশ্নটা আলোচনা করা যাক। সে জন্যে একজন সাধারণ মানুষের একটি মামুলি দিনের জীবনকে নেয়া যাক। সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি জীবন শুরু করেন, এতে তার বিশ্বাসের কোন প্রভাব নেই। তিনি সকালে নাস্তা করেন, ট্রেন ধরেন, পত্রিকা পড়েন, অফিসে যান-এ সকল অভ্যাসবশেই করে থাকেন। তার জীবনে অতীতে এমনও এক সময় ছিল যখন তিনি এ অভ্যাসগুলোকে গঠন করেছেন এবং অন্ততঃ তার অফিস পছন্দের ব্যাপারে তার বিশ্বাসের প্রয়োজনীয় ভূমিকা ছিল। চাকুরি গ্রহণ করার সময়ে তিনি হয়ত ভেবেছিলেন, নিজের জন্য যা ভালো মনে করেন, ঐ চাকুরিতে যোগ দিলেই তার সব কিছু পেতে পারেন। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে বৃত্তি নির্বাচন করার বেলায় বিশ্বাস অসামান্য ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং পছন্দ থেকেই মানুষের সকল রকমের বিশ্বাসের উৎপত্তি।
অফিসে তাকে যদি পরের অধীনে কাজ করতে হয়, তাহলে কোন সক্রিয় সংকল্প অথবা বিশ্বাসের কোন প্রকাশ্য বাধার সম্মুখীন না হয়ে অভ্যাসবশে কাজ করে যেতে পারেন। যদি তিনি অঙ্কের সঙ্গে অঙ্ক বসিয়ে স্তম্ভ তৈরি করেন, তাহলে বলতে হবে তিনি যে গাণিতিক নিয়ম প্রয়োগ করেন, তাতে বিশ্বাস করেন;কিন্তু তা করলে এক বিরাট ভুল করা হবে, নিয়মগুলো টেনিস খেলোয়ারের স্বভাবের মতো তার শরীরের স্বভাবমাত্র। যৌবনে ওগুলোকে আয়ত্ব করা হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট কোন বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাসের বশে নয়। কুকুর যেমন পেছনের পায়ের উপর উপবেশন করে খাবার খেতে শিক্ষা করে, তেমনি ওসব স্বভাবও স্কুল শিক্ষকদের সন্তুষ্ট করার জন্য আয়ত্ব করা হয়েছিল। আমি বলতে চাই না যে সকল শিক্ষা এক রকম, কিন্তু নিশ্চিতভাবে প্রত্যেক শিক্ষা প্রাথমিক স্তরে ঐরকম।