প্রত্যেক নৈতিক পদ্ধতি কতকগুলো বিশ্লেষণাতীত বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত, একথা ধরে নেয়া যায়। দার্শনিক প্রথমে বস্তুর প্রকৃতি সম্বন্ধে একটা মিথ্যা থিয়োরি আবিষ্কার করে, তারপরে উপসংহারে, যে সকল কর্ম সে থিয়োরিকে মিথ্যা বলে দেখিয়ে দেয়, সে গুলোকে খারাপ কাজ বলে আখ্যায়িত করে। ঐতিহ্যবাদী খ্রিস্টানদের দিয়ে শুরু করা যাক। তাদের মতে প্রত্যেক জিনিস ঈশ্বরের হুকুম মেনে চলে, সুতরাং ভগবানের হুকুম অমান্য করাটাই হলো গর্হিত কাজ। তারপরে ধরা যাক হেগেলপন্থীদের কথা, তাদের মতে ব্রহ্মাণ্ড হলো বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে সৃষ্টি একটি পরিপূর্ণ জীবদেহ বিশেষ, সুতরাং তাদের মতে সে সমস্ত হলো মন্দস্বভাব যে গুলো ব্রহ্মাণ্ডের মৃসণগতিকে খাট করে দেখে, কি রূপে এ জাতীয় ব্যবহারের উৎপত্তি হয় যদিও তা তলিয়ে দেখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার, কেননা এ তাদের থিয়োরির জন্যে ব্রহ্মাণ্ডের নিরংকুশ সঙ্গতি বিজ্ঞানের প্রয়োজন। ফরাসি জনগণের জন্য লিখবার সময় বের্গসঁকে যারা সমর্থন করেন নি তাদের তিনি ভয় দেখিয়েছেন যা নৈতিকভাবে ঘৃণা করার চাইতেও মারাত্মক। আমি তার হাস্যাস্পদ করার ভয়ের কথাই বলছি। তিনি দেখিয়েছেন যে মানুষ কখনো যান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করে না এবং হাসি (Laughter) বইতে তিনি বলেছেন কোন মানুষকে যান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করতে দেখলেই আমাদের হাস্যোদ্রেক হয়। সুতরাং বের্গসঁর দর্শনকে যখন আপনি ভ্রান্ত বলবেন তখনই আপনি হাস্যাস্পদ ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। দর্শনের কোন নৈতিক ফলশ্রুতি যে মিথ্যার উপর ভর করা ছাড়া থাকতে পারে না, এই উদাহরণগুলো তা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেবে বলে আমি আশা করি, বরঞ্চ সত্যিকারের নৈতিক ভিত্তি বলে কোন কিছু থাকলে যে কাজগুলো তা পাপ বলে সংজ্ঞায়িত করে কখনো সে সব করা সম্ভব হতো না।
আচরণবাদের ক্ষেত্রে এসকল মন্তব্য প্রয়োগ করে, আমি এ সিদ্ধান্তে এসেছি যে, এর যদি কোন নৈতিক ফলাফল থেকে থাকে তা ভ্রান্ত। পক্ষান্তরে সত্যিকারের কে” নৈতিক ভিত্তি থাকলে আচরণের উপর এর কোনও প্রভাব নেই। প্রচলিত আচরণবাদের ক্ষেত্রে (যদিও কড়াকড়ি বৈজ্ঞানিকভাবে নয়) এগুলো প্রয়োগ করে আমি ভ্রান্তির কয়েকটা প্রমাণ পেয়েছি। প্রথমতঃ কোন নৈতিক ফলাফল নেই একথা মানুষ জানতে পেলে সবরকমের বিশ্বাসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এক্ষেত্রে আলাদা করার প্রয়োজন আছে। সত্য মতবাদের নৈতিক ফলাফল না থাকলেও বাস্তব ফলাফল রয়েছে। যদি কোন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র যেটাতে দুটো মুদ্রা দিয়ে জিনিস নেয়া যায় এত করে তৈরি করা হয়েছে, একটাকে দিয়ে নিতে চাইবার চেষ্টা করে যখন বিফল হবেন, সেখানে সত্যের বাস্তব ফলাফল মানে আপনাকে আর একটা মুদ্রা দিতেই হবে। কেউ একে নৈতিক বলবে না, কিভাবে আপনার ইচ্ছাকে সন্তুষ্ট করতে হবে তার সঙ্গেই এর সম্বন্ধ। একইভাবে ড. ওয়াটসনের বইয়ে এমন সব বিষয় বিকশিত করা হয়েছে, যেগুলো বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল রয়েছে। আপনি যদি একটি শিশুর ব্যবহার বিশেষভাবে চালিত করতে চান, তাহলে ফ্রয়েডের চেয়ে ড. ওয়াটসনের উপদেশ অনুসরণ করা আপনার পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু তা নৈতিক নয়। বৈজ্ঞানিক ব্যাপার, যখন কতেক কাজকে তাদের ফলাফলের চাইতে স্বাধীনভাবে করা উচিত বলে আপনি মনে করেন, তখনই আসে নৈতিকতা।
আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে আচরণবাদ যতই অযৌক্তিক হোকনা কেননা প্রকৃত অর্থে একটা নীতিশাস্ত্রের অনুমোদন করে। এর যুক্তি হতে পারে, আমরা শুধুমাত্র পদার্থকে গতিশীল করতে পারি, সুতরাং আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সে পরিমাণ পদার্থ গতিশীল করা উচিত এবং শিল্পকলা ও চিন্তাভাবনা যে পর্যন্ত বস্তুর গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে, সে পরিমাণ মূল্যবান। সে যাহোক, এ হলো দৈনন্দিন জীবনধারণের একটি অতি দার্শনিক বৈশিষ্ট্য। এর বাস্তব বৈশিষ্ট্য হলো উপার্জন। ড. ওয়াটসনের থেকে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি নেয়া যাক।
“চরিত্র এবং ক্ষমতা ব্যক্তির বার্ষিক সাফল্যের নিরিখে পরীক্ষা করাই হলো আমার মতে ব্যক্তিত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহের মধ্যে একটি। আমরা তা নিরপেক্ষভাবে সময়ের দীর্ঘতা অনুসারে যে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার আয়ের বৃদ্ধি সাধন করেছে বার্ষিক হিসাব যে অনুসারে করতে পারি। যদি ব্যক্তিটি একজন লেখক হয় তাহলে বছর বছর গল্প লেখার সে টাকা পেয়েছে একটি বক্ররেখা এঁকে তা দেখাতে পারি। আমাদের প্রধান সাময়িকী থেকে তিরিশ বছর বয়সে গড়পড়তা যা পাচ্ছে, চল্লিশ বছর বয়সেও সে একই টাকা পেয়েছিল তাহলে আমাদের ধরে নিতে হবে সে একজন বাজে লেখক, এছাড়া আর কিছু সে করতে পারবে না!”
বুদ্ধ, খ্রিস্ট, মুহম্মদ, মিলটন এবং ব্লেক সম্পর্কে একই বৈশিষ্ট্য আরোপ করলে আমাদের ব্যক্তিত্বের স্বরূপ নির্ধারণের বেলায় একটি আকর্ষণীয় পুনঃসামঞ্জস্য বিধানের দেখা পেয়ে থাকি। উল্লিখিত অনুচ্ছেদে ব্যক্ত বিষয় ছাড়া আরো দু’টো মতামত সংগোপনে বিরাজমান। তার একটা হলো উৎকর্ষকে সহজে অনুধাবনশীল হতে হবে, অন্যটা আইনত তাতে একটা পারস্পর্য বজায় থাকতে হবে। এ দুটো হলো পদার্থবিজ্ঞানের থেকে উপসংহার হিসেবে নীতিশাস্ত্রে অবতরন করার পদ্ধতি। কিন্তু আমার মতে, উল্লেখিত অনুচ্ছেদে ড. ওয়াটসন যে নীতিশাস্ত্রের বর্ণনা করেছেন তা আমার পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়। গুণ যে আয়ের অনুপাতে নির্ধারিত হয় একথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনে। অথবা দলের সঙ্গে না মিশতে পারার অসুবিধাকেও আমি দোষ মনে করিনে। এসব বিষয়ে আমার মত যে একপেশে তাতে সন্দেহ নেই, কেননা আমি হলাম গিয়ে দরিদ্র এবং যান্ত্রিক। তারপরেও এ সত্য আমি স্বীকার করি যে, সেগুলো আমারই মতামত, নির্দ্বিধায় তা আমি বলতে পারি। এখন আমি আচরণবাদের আরেকটি দিক-নাম করে বলতে গেলে এর শিক্ষাগত দিকটি সম্পর্কে আলোচনা করব। এখানে আমি ড. ওয়াটসনের উদ্ধৃতি দেবো না, কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে তার মতামতসমূহকে আমার খুবই সুন্দর মনে হয়েছে। কিন্তু তিনি তার বইতে শিক্ষার পরবর্তী স্তর সম্পর্কে কিছুই বলেননি এবং সেখানেই আমার ঘোরতর সন্দেহ। আমি একটা বই নিচ্ছি যা সম্পূর্ণভাবে আচরণবাদী না হলেও আচরণবাদ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গীর অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছে। বইটির নাম ‘শিশু, তার প্রকৃতি এবং প্রয়োজন।’ (The child, his nature and his needs) বইটির প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। কেননা মনস্তত্ব বইটিতে খুবই প্রশংসনীয়ভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে; কিন্তু নীতিশাস্ত্র এবং সৌন্দর্যের তত্ত্বে সমালোচনার প্রচুর অবকাশ রয়ে গেছে বলে আমি মনে করি। তত্ত্বের অপর্যাপ্ততা দেখাবার জন্য আমি নীচের অনুচ্ছেদটির উদ্ধৃতি দিচ্ছি। (পৃঃ সংখ্যা ৩৮৪)