শুধু নৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের বাহ্যিক ক্ষতিকর কাজ বন্ধ করাকে আমাদের স্বৈরাচারী প্রবৃত্তিগুলোর নিরসনের পক্ষে পর্যাপ্ত বলে মনে করা উচিত নয়। এ কারণে নিরসন হয় না যে আমাদের প্রবৃত্তির মধ্যে কতকগুলো মধ্যযুগীয় শয়তানের মতো এমন ছদ্মবেশ ধরতে সক্ষম যে সবচেয়ে সতর্ক তা ফাঁকি দিতে পারে। আমাদের চরিত্রগত প্রবৃত্তিকে পরিতৃপ্তি বিধান করার একমাত্র পন্থা হলো ওগুলোর কিসের প্রয়োজন তা জানা এবং কিভাবে যথাসত্বর কম ক্ষতিকর উপায়ে তার পরিতৃপ্তি বিধান করা যায় তা আবিষ্কার করা। যেহেতু যন্ত্র স্বতঃস্ফূর্ততাকে বিনষ্ট করেছে, একমাত্র সুযোগকেই তার স্থলাভিষিক্ত করতে হবে এবং তা ব্যক্তিক অভিরুচির এখতিয়ারে ছেড়ে দেয়া উচিত। সন্দেহ নেই, এতে বিস্তর খরচ পড়বে, কিন্তু সে খরচ কোনক্রমেই একটা যুদ্ধের ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। মানবচরিত্রের সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান অবশ্যই মানবজীবনের যে-কোন রকমের উন্নতির ভিত্তি হবে। বহির্বিশ্বের প্রাকৃতিক আইনকে আয়ত্ব করে মানুষ অসাধ্য সাধন করেছে। এ পর্যন্ত আমরা ইলেকট্রোন এবং নক্ষত্রলোক সম্বন্ধে যতটা জানতে পেরেছি নিজেদের চরিত্রের সম্বন্ধে জানাশোনার পরিমাণ তার চেয়ে অনেক স্বল্প। যখন বিজ্ঞান মানবচরিত্র জানতে শুরু করেছে তখন আমাদের জীবনের সুখ সন্তুষ্টি বিধান করতে সক্ষম হবে যা এতকাল প্রকৃতি বিজ্ঞান কিংবা যন্ত্রপাতি দিয়ে বারবার অকৃতকার্য হয়েছে।
০৭. আচরণবাদ এবং মূল্যবোধ
একখানি আমেরিকান উন্নত ধরনের সাময়িকীতে আমি একদিন এ বক্তব্য দেখতে পেলাম যে পৃথিবীতে একজন মাত্র আচরণবাদী আছেন, তার নাম হলো ড. ওয়াটসন। কিন্তু পৃথিবীতে আধুনিকমনা মানুষের সংখ্যা বেশি বলে আমার মতে তাদের সংখ্যাও বেশি। তার অর্থ আমি এ বলছি না যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যত্রতত্র আচরণবাদীদের দেখা মেলে। তা সত্ত্বেও আমি ছিলাম আচরণবাদী, কিন্তু রাশিয়া এবং চীন না দেখা পর্যন্ত, আমি যে আধুনিক নই সে কথা আমি হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি। নিরপেক্ষ আত্মসমালোচনা আমাকে এ সত্য বিশ্বাস করতে বাধ্য করল যে, যদি আমি তা হই তাহলে মঙ্গলজনক হবে। এ প্রবন্ধে আমার মতো মানুষেরা অনুভব করে এমন কতক অসুবিধা সম্বন্ধে আলোচনা করতে চাই। বিজ্ঞানে আধুনিকতা কী তা গ্রহণ করতে গিয়ে মধ্যযুগীয় ধারণা থেকে আলাদা করার বেলায় জীবনধারণের ক্ষেত্রে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। মূল্যবোধের উপর আচরণবাদের কি যুক্তিগত প্রভাব পড়েছে আমি শুধু সে সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে চাইনে; কিন্তু সাধারণ মানব-মানবীর উপর এর যা প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যদি তাও ব্যাপকভাবে অশোধিত উপায়ে গৃহিত হয়, আমি সে সম্বন্ধেও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই। আচরণবাদ মনঃসমীক্ষার এত উম্মত্ত হয়ে এখনো ওঠেনি, তা যদি কখনো তেমন হয়ে ওঠে তাহলে ড. ওয়াটসনের শিক্ষার সঙ্গে তার আসমান জমিন তফাৎ হবে। যেমন প্রচলিত ফ্রয়েডবাদ বহুলাংশে ফ্রয়েডের চেয়ে ভিন্নতর।
আচরণবাদের মোদ্দাকথা হলো আমার মতে, অতীতে মন বলে একটা জিনিস ছিল যা অনুভব, জানা এবং ইচ্ছা এই তিনরকম ক্রিয়া করতে সক্ষম ছিল। মন বলে যে কিছু নেই বর্তমানে তা উদঘাটিত হয়েছে, শরীরটাই সব। শারীরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই আমাদের সকল রকম কর্মপ্রক্রিয়া নিহিত। অনুভূতি হচ্ছে অন্তর যন্ত্র সম্পর্কিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে গ্রন্থির সঙ্গে সংযোগশীল যে সকল প্রতিক্রিয়া। জানা হচ্ছে গলঃনালীর সঙ্গে সম্পর্কশীল ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া। ইচ্ছা হচ্ছে আমাদের শরীরের ডোরাকাটা পেশীর আর সকল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। সম্প্রতি একজন বিখ্যাত নর্তকী যখন একজন বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীকে বিয়ে করলেন, তাদের মধ্যে সমতার অভাব দেখতে পেলেন কেউ কেউ। কিন্তু আচরণবাদে এ ধরণের সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। নৃত্যপটিয়সী ভদ্রমহিলা হাত এবং পায়ের চর্চা করেছেন এবং ভদ্রলোক গলঃনালীর পেশীসমূহের চর্চা করেছেন, সুতরাং আলাদা পেশার আলাদা পদ্ধতি হলেও তারা দুজনেই পেশীসঞ্চালনকারী। আমরা একমাত্র শরীরসঞ্চালন করতে পারি বলে সাধারণের পক্ষে স্থির ধারণা পোষণ করা খুবই স্বাভাবিক, যে আমরা শরীরকে যদৃচ্ছা সঞ্চালন করতে পারি। এ ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতত্ত্ব অথবা রিলেটিভিটি সম্বন্ধীয় অসুবিধার সৃষ্টি হবে। প্রশ্ন হলো, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কি পরস্পর আপেক্ষিকভাবে কাজ করা উচিত? না শরীর সামগ্রিকভাবে শরীরযন্ত্রের নিয়মানুসারে কাজ করে অথবা পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কশীল যে গতি তাই কি এ গুণের একমাত্র বৈশিষ্ট্য। প্রথম মতামত অনুসারে অঙ্গ সঞ্চালনকারী দড়িবাজিকর হবে আদর্শ মানুষ; দ্বিতীয় মতানুসারে আদর্শ মানুষ হবে ক্রমশ নিম্নে অবতরণকারী মই বেয়ে উঠে যাওয়া মানুষ; তৃতীয় মতানুসারে যে মানুষ সারাজীবন উড়োজাহাজে কাটিয়ে দেয় সে আদর্শ মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে। ফলশ্রুতিস্বরূপ যে বিতর্কের সৃষ্টি হবে কোন নীতি অবলম্বন করলে পরে তার নিষ্পত্তি হবে তা বলা খুব সহজ হবে না। সে যাহোক শেষমেষ আমি শূন্যচারীদের কথা বলছি।
সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্প্রদায়কে যে উৎকর্ষ সাধিত ধারণাসমূহ পরিচালিত করে সে সব বিবেচনা করলে আমরা এ উপসংহারে আসতে বাধ্য হব যে আচরণবাদকে সত্য বলে বিশ্বাস করে নেয়া হয়েছে তা শুধুমাত্র থিয়োরিগত যৌক্তিকতাই প্রদান করে। যারা শরীরচর্চায় বিশ্বাসী এবং যাদের মতে খেলোয়ারদের উপর জাতির পৌরুষ নির্ভরশীল, অঙ্গ সঞ্চালনকারী দড়িবাজিকররা তাদের নিকট আদর্শ মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে। বৃটিশ শাসকশ্রেণীর অনুসৃত মতবাদ হলো তাই। নিম্নে অবতরণকারী মইয়ে চড়ে উপরে উঠে যাওয়া মানুষ পেশীবান খ্রিষ্টানদের আদর্শ মানুষ বলে স্বীকৃতি অর্জন করবে। তারা মনে করে পেশীর উৎকর্ষ সাধন করা চূড়ান্ত মঙ্গলজনক কিন্তু তার সঙ্গে আনন্দের কোন সংযোগ থাকতে পারবে না। এই মতবাদ ওয়াই. এম. সি. এ চীন দেশে প্রবর্তন করার চেষ্টা করেছে এবং শাসকেরা শাসিত সকল জাতি এবং শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শূন্যচারীরা, যান্ত্রিক শক্তি ব্যবহারকারীদের জন্য সংরক্ষিত অভিজাত আদর্শ। কিন্তু এসবের উর্ধ্বে একটি সর্বোচ্চ ধারণা রয়েছে যা এরিস্টটলের আনমুভড মুভার (Unmoved mover) বা অচলা চালকের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সে হলো কেন্দ্রের শাসনকর্তা আর সকলে তার চতুর্দিকে বিভিন্ন গতিতে পরিভ্রমণ করে তার জন্য সর্বোচ্চ গতিসঞ্চয় করবে। এই ভূমিকা আমাদের অতিমানুষ, বিশেষ করে পুঁজিপতিদের জন্য সুনির্দিষ্ট। আমাদের কল্পনার উপর যন্ত্রের ক্রমশ জবরদখলের ফলে মানবোকর্ষের যে ধারণা গ্রিকযুগ এবং মধ্যযুগ থেকে আমরা পেয়েছি, তার চাইতে আলাদা একটি দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তিগতভাবে আচরণবাদের সঙ্গে খাপ খেতে পারে, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিতে গড়পড়তা নাগরিকের ক্ষেত্রে তা অচল। সে প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে অনুভূতি এবং জানাকে কর্মের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হতো। শিল্পকলা এবং ধ্যান-ধারণাকে বিশাল পরিমাণ পদার্থের পরিবর্তন সাধন করার মতো প্রশংসনীয় জ্ঞান করা হতো। নিষ্কাম ঈশ্বরপ্রেম এবং নির্মল ঈশ্বরভক্তিই তাদের দৃষ্টিতে মানবের সর্বোচ্চ উৎকর্ষ করা হতো। আদর্শের সবটাই ছিল স্থির অনড়। স্বর্গে সঙ্গীত গাওয়া হয় এবং বীণা বাজানো হয় একথা সত্য, কিন্তু প্রত্যেকদিন একই সঙ্গীত গাওয়া হয় বীণা যন্ত্রের কেননা উন্নতি সহ্য করা হয় না। এরকম কিছুর অস্তিত্ব আধুনিক মানুষের কাছে বিরক্তিকর। মিলটন নরকে যন্ত্রপাতি পাঠাতে পারলেও স্বর্গে তার পক্ষে উন্নত ধরণের যন্ত্রপাতি পাঠানো সম্ভব হয় নি। ধর্ম মতের মার খাওয়ার কারণসমূহের মধ্যে এটি হলো একটি।