ইতোমধ্যে যন্ত্র আমাদের দুটো জিনিস থেকে বঞ্চিত করেছে। মানুষকে সুখী হতে হলে তার চরিত্রে এ দুটোর অতীব প্রয়োজন। উপাদান দুটো হলো বৈচিত্র এবং স্বতঃস্ফূর্ততা। কলের নিজস্ব ক্ষুধা আছে এবং ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য নিজস্ব দাবি আছে। যে মানুষ কলের মালিক সে তা অবশ্যই চালু রাখবে। আবেগসমূহের দৃষ্টিকোণ থেকে যন্ত্রের নিয়মতান্ত্রিকতাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিপত্তি। যে সব মানুষ নিজেদের সিরিয়াস বলে ধারণা করে তাদের যন্ত্রের সবগুলো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলে প্রশংসাও করা হয়। উদাহরণস্বরূপ তারা বিশ্বাসযোগ্য, সময়নিষ্ঠ, যথার্থ ইত্যাদি ইত্যাদি। এর কারণ হলো যন্ত্র মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। একটি খারাপ জীবন এবং একটি অনিয়মিত জীবনে বর্তমানে বিশেষ প্রভেদ নেই। বের্গসঁর দর্শন এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ। যদিও আমার মনে হয়, তিনি শুধু মানুষকে সর্বতোভাবে যন্ত্রে রূপায়িত হতে দেখে আতংকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
জীবনে আমাদের চিন্তার প্রতিকূল বিদ্রোহী প্রবৃত্তিগুলো যন্ত্রের দাসত্বে অস্বীকৃতি জানিয়ে একটি চরম অশুভ দিকে মোড় নিয়েছে। সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপনের শুরু থেকে যুদ্ধস্পৃহা বর্তমান ছিল কিন্তু আমাদের যুগের এত তা ভয়াল ভয়ংকর রূপ ধারণ করেনি কখনো। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বিশ্বে নেতৃত্ব করার আকাঙ্ক্ষায় ইংল্যাণ্ড এবং ফরাসি দেশের মধ্যে অসংখ্য যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু সকল সময়ে তারা পরস্পর পরস্পরকে পছন্দ করত এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধও তাদের অক্ষুণ্ণ ছিল। বন্দী অফিসারেরা সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডে যোগদান করতেন এবং ডিনার পার্টিতে সম্মানীয় অতিথি বলে গণ্য হতেন। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে যখন আমাদের সঙ্গে হল্যাণ্ডের যুদ্ধ হয় তখন ওলন্দাজলের নিষ্ঠুর কার্যকলাপের গল্পসহ একজন মানুষ এলেন আফ্রিকা থেকে। আমরা বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা উৎসাহিত হয়ে ধারণা করেছিলাম যে গল্পগুলো অলীক, তাকে শাস্তি দিয়েছিলাম এবং ওলন্দাজদের অস্বীকৃতি ছাপিয়ে প্রকাশ করেছিলাম। গতযুদ্ধে হলে আমরা তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করতাম এবং তার সত্যনিষ্ঠায় কেউ সন্দেহ করলে আমরা তাকে জেলখানায় পাঠাতাম। যন্ত্রের কারণে আধুনিক যুদ্ধ জঘণ্যভাবে নৃশংস এবং এ নৃশংসতা তিনটি উপায়ে সক্রিয়। প্রথমতঃ যন্ত্র অধিক সংখ্যক সৈন্য রাখার সুযোগ দিয়ে থাকে। দ্বিতীয়তঃ খবরের কাগজের সস্তা প্রচার মানুষের অপকৃষ্ট বৃত্তিসমূহ আগুন ধরিয়ে দেয়। তৃতীয়তঃ মানব চরিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত স্বৈরাচারী দিকটি যা অন্তঃশীলা স্রোতে অস্পষ্ট একটা অতৃপ্তির ভাব সৃষ্টি করে, যার ফলে যুদ্ধের আবেদন মানুষের চোখে অতৃপ্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা পন্থার এত ঠেকে। এই তৃতীয় পন্থাটিকে ঘিরেই আমাদের আলোচনা। গতযুদ্ধের এত বিরাট একটা রদবদলকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রনৈতিকদের দুরভিসন্ধি মনে করা আমাদের পক্ষে ভুল হবে। রাশিয়ার মানুষের মধ্যে এ বোধ পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল বলে তারা বোধ হয় সর্বান্তঃ করণে যুদ্ধ না করে একটা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের জার্মানি ইংল্যাণ্ড এবং আমেরিকার কোন সরকার যুদ্ধের জনপ্রিয় দাবিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারত না। এরকম জনপ্রিয় দাবির পেছনে অবশ্যই একটা প্রাকৃকিত ভিত্তি আছে। আমার মতে আধুনিক নিয়মনিষ্ট একঘেঁয়ে জীবনের অসন্তোষ, অতৃপ্তি (যা অনেকাংশে অচেতন) এই যুদ্ধপ্রিয় মনোভাবের সহায়ক হয়েছে।
এটা স্পষ্টতঃ সত্য যে, আমরা যন্ত্রপাতিকে বিদায় করে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারিনে। এরকমের প্রচেষ্টা প্রতিক্রিয়াশীল এবং সর্বক্ষেত্রে অবাস্তব প্রমাণিত হবে। কল-কারখানা জীবনে যে দুর্বিসহ অভিশাপ বয়ে এনেছে, দুঃসাহসিক অভিযানের অনুপ্রেরণায় বেড়িয়ে পড়ে একঘেঁয়েমী ভঙ্গ করা হলো তা এড়িয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা আল্পস পর্বতের শিখরে আরোহন করেছে তারা তখনও যুদ্ধকে কামনা কররেব কি? শান্তির একজন উৎসাহী এবং কর্মক্ষম কর্মীর সঙ্গে পরিচিতি হবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, যিনি অভ্যাসবশে আল্পসের সবচেয়ে বিপদ-সংকুল শৃঙ্গে আরোহণ করে সারা গ্রীষ্মকাল অতিবাহিত করেন। যদি প্রত্যেক শ্রমজীবী মানুষকে তাদের ইচ্ছানুসারে উড়োজাহাজ চালানো শিক্ষা দেয়া যায় অথবা সাহারায় নীলকান্ত মণির সন্ধানে পাঠানো হয় অথবা তার আবেগে নাড়া দিতে সক্ষম তেমন কোন উত্তেজনাপূর্ণ কাজে পাঠানো হয় তাহলে যুদ্ধের জনপ্রিয় দাবি প্রতিযোগিতায় এসে দাঁড়াবে এবং ধীরে ধীরে সময়-প্রীতি লোপ পেয়ে যাবে। বিবদমান শ্রেণীসমূহকে শান্ত করার কোন পদ্ধতি আমার জানা নেই, একথা আমি স্বীকার করি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি একটা বৈজ্ঞানিক দর্শনের আঙ্গিকে অন্তরঙ্গভাবে অনুসন্ধান করলে একটা পদ্ধতির সন্ধান অবশ্যই মিলবে।
যন্ত্র আমাদের জীবনধারায় পরিবর্তন বয়ে এনেছে, কিন্তু প্রবৃত্তিকে নয়। ফলতঃ অসামঞ্জস্য ঘটেছে। আবেগ এবং দর্শন এখন পর্যন্ত শৈশবাবস্থায় রয়ে গেছে। মনঃসমীক্ষা সবেমাত্র সে দর্শনের সূত্রপাত করেছে, কিন্তু তাও আগে যেখানে ছিল বর্তমানেও সেখানে স্থির অনড়ভাবে রয়ে গেছে। মানুষ এমন অনেক কাজ করে, এমন অনেক কিছু চায় যা তার আসল কাম্য নয়। অযৌক্তিক বিশ্বাসের বশে না জেনে মানুষ জীবনের ভিন্নরকম পরিণতি কামনা করে অন্তত আমরা এটুকু মনসমীক্ষা থেকে গ্রহণকরতে পারি। কিন্তু গোঁড়া মনঃসমীক্ষা অন্যায়ভাবে আমাদের সচেতন উদ্দেশ্যেরও সরলীকরণ করে ফেলেছে এবং তা অসংখ্য আর ব্যক্তিতে ব্যক্তিত্বে বিভিন্ন। এটা আশা করা যায় যে শিগগির এমন রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যখন এই দৃষ্টিকোণ থেকে মানবচরিত্রের উপর আলোকপাত করা সম্ভব হবে।