মানুষের যেমন শারীরিক প্রয়োজন আছে, তেমনি তার মধ্যে আবেগ আছে। যেখানে মানুষের প্রথমটির অভাব মিটেনা সেখানে দ্বিতীয় অভাবগুলোই প্রথম এবং প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। শারীরিক প্রয়োজন মিটলে পরে প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পর্কহীন আবেগরাশি মানুষ সুখী কি অসুখী তা নির্ধারণ করতে তৎপর হয়ে ওঠে।
আধুনিক শিল্পাঞ্চলসমূহের অনেক মানব-মানবী এবং শিশু প্রয়োজন মতো শারীরিক অভাব মিটাতে পারেনা। আয় বৃদ্ধি হলো তাদের সুখবৃদ্ধির প্রথম সোপান একথা আমিও স্বীকার করি। সেগুলো অতিরিক্ত নয় সংখ্যার সে জন্যে সকলের শারীরিক প্রয়োজনের উপকরণাদি সরবরাহ করা অসম্ভব কিছু নয়। আমি তাদের কথা বলছি না, বলছি তাদের কথা, যাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আছে, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি যাদের আছে তাদের নয়, সামান্য পরিমাণ বেশি যাদের আছে তাদের কথাও বলছি। আমরা সকলে উপার্জন বাড়াতে চাই, তার কারণটা কী? প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে আমাদের আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করতে পণ্যদ্রব্যের প্রয়োজন। আদতে আমরা প্রতিবেশীদের উঁট দেখাবার জন্যে পণ্যদ্রব্য কামনা করে থাকি। যখন একজন মানুষ পুরনো খারাপ বাসা ছেড়ে একটি রুচিসম্মত ঘরে উঠে আসে, তখন সে মনে করে এবার উন্নত ধরনের লোকেরা তার স্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করবে, বিগত অসচ্ছল দিনের চিহ্ন জীবন থেকে এভাবে বুঝি মুছে যাবে। ছেলেকে ভালো স্কুলের অথবা ব্যয়বহুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে বেশি মাইনে দিয়ে সামাজিক মর্যাদার আসন দখল করে নিলো বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। ইউরোপ, আমেরিকার বড় শহরে কোন কোন অঞ্চলের ভালো ঘরের ভাড়া অন্যান্য অঞ্চলের ভালো ঘরের ভাড়ার চাইতে অনেক বেশি এ কারণে যে সেগুলো অত্যন্ত সৌখিন। আমাদের মনের গভীরে সম্মানিত এবং প্রশংসিত হওয়ার আকাঙ্খ অত্যন্ত প্রবল। স্বাভাবিকভাবেই ধনীলোকেরা অত্যধিক শ্রদ্ধা এবং সম্মান পেয়ে থাকে। মানুষের ধনী হওয়ার আসল কারণ হলো এটি। টাকা দিয়ে তারা যে সকল জিনিস ক্রয় করে, তার ভূমিকা সেখানে প্রথম নয়, দ্বিতীয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, যে কোটিপতি এক ছবি থেকে আরেক ছবির পার্থক্য পর্যন্ত বোঝে না সেও বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে ওল্ড মাষ্টারদের ছবি কিনে আর্ট গ্যালারি রচনা করে। অন্যেরা কত খরচ করেছে তা অবাক হয়ে ভাববে-ছবিগুলো শুধু এই আনন্দই তাকে দিয়ে থাকে। নিজের শ্লাঘা বোধ থেকে এই আনন্দ সে কখনো পেতে পারে না।
এই বোধ বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে এবং বিভিন্ন সমাজে এর প্রকাশভঙ্গী বিভিন্ন। অভিজাত সমাজে মানুষকে জন্মের জন্যে সম্মান করা হয়। প্যারির কোন কোন মহল মানুষকে, তার জীবন যতই বিচিত্র হোকনা কেনো শিল্পপ্রতিভার জন্যেই সম্মান করা হয়ে থাকে। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মানুষ তার জ্ঞানের জন্য সম্মানিত হয়। ভারতে সন্নাসীদের সম্মান করা হয়। চীনদেশে সাধুদের। বিভিন্ন সমাজ পর্যবেক্ষণ আমাদের বিশ্লেষণের যথার্থতাই প্রমাণ করে। সকল সমাজের মধ্যে এমন কতক মানুষের দেখা পাওয়া যায় তারা যতক্ষণ পর্যন্ত টাকা পয়সা ছাড়া বেঁচে থাকা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত টাকা পয়সার প্রতি চরম ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে। কিন্তু যে গুণটির বলে পরিবেশকে মুগ্ধ করে সম্মানিত হয় সে গুণটির পরিচর্যা করে তারা।
এসব বাস্তব সত্যের প্রাধান্য এটা প্রমাণ করে যে সম্পদের প্রতি আধুনিক মানুষের আকাঙ্ক্ষা তার প্রবৃত্তির গভীরে প্রোতিত নয়। ভাসা ভাসা আকাঙ্ক্ষাকে বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার মাধ্যমে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া যায়। যদি আইন করে সকলের আয় সমান করে বেঁধে দেয়া হয়, তাহলে প্রতিবেশীদের চাইতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবার জন্য অন্য পথের সন্ধান করতে হবে। পণ্যদ্রব্য হস্তগত করার আকুলি বিকুলির অনেকাংশে নিরসন হবে। যতদিন প্রতিযোগীদের মধ্যে তীব্র আকাক্ষা বিরাজ করবে ততদিন আমরা প্রতিবেশীদের হারিয়ে দিয়ে তাদেরকে যতটুকু বেদনার্থ করতে পারব নিজেরাও ততটুকু পুলকিত হব। সম্পদের বৃদ্ধির ফলে প্রতিযোগিতামূলক কোন সুবিধা যেমন আসেনা, তেমনি দিতে পারে না প্রতিযোগিতামূিলক কোন সুখের সন্ধান। পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে উপভোগ করার মধ্যে সত্যিকারের কিছুটা আনন্দ আছে। কিন্তু আমরা দেখেছি, যে বস্তু আকাঙ্ক্ষা করি এ তার কিয়দংশ মাত্র। এতদূর পর্যন্ত যখন দেখা গেলো আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো প্রতিযোগিতামূলক এবং সে অনুসারে অতিরিক্ত ধনাগমের ফলে মানুষের সাধারণ অথবা বিশেষ কোন সুখের বৃদ্ধি সাধন করেনা।
যন্ত্র মানুষের সুখ বৃদ্ধি করে। এর সমর্থনে যদি যুক্তি দেখাতে হয় তারপরেও যে পরিমাণ উন্নতি বিধান করে থাকে চরম দারিদ্রের নিরোধক হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ছাড়া এর সমর্থনে যন্ত্র কোন মূল্যমানের প্রতিষ্ঠা করে না। কোন যন্ত্র সেভাবে ব্যবহৃত হবে তার কোনও সংগত কারণ নেই। যেখানে জনসংখ্যা স্থির সেখানে যন্ত্র ছাড়াও দারিদ্রের নিরসন করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ফরাসিদেশে দারিদ্র খুবই কম, যদিও সে দেশে কল-কারখানা আমেরিকা, ইংল্যাণ্ড এবং যুদ্ধপূর্ব জার্মানির তুলনায় অনেক কম,পরোক্ষভাবে কল-কারখানা যেখানে বেশি সেখানে অভাবও বেশি। একশ বছর আগেকার ইংল্যাণ্ডের শিল্পাঞ্চলগুলো এবং বর্তমান জাপানকে তার দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যন্ত্রের সাহায্যে নয় শুধু, অভাব দূর করতে হলে আমাদেরকে অন্যকিছুর উপর নির্ভর করতে হবে। অভাবকে বিজয় করা ছাড়া সম্পদ বৃদ্ধি করার মূল্য তেমন বেশি কিছু নয়।