যন্ত্র এবং আবেগের মধ্যে কোন বিবাদ কেনো থাকবে, আপাতঃদৃষ্টিতে তা ধরা পড়ার কথা নয়। প্রত্যেকটি শিশু স্বাভাবিকভাবে যন্ত্র ভালোবাসে। অত্যাধিক শক্তিধর এবং প্রকাণ্ড যন্ত্রের প্রতি তার আকর্ষণ প্রচণ্ড। জাপানিদের মতো যে জাতির ঐতিহ্য শৈল্পিক বিশেষত্ব আছে, সংস্পর্শে আসা মাত্রই প্রতীচ্যের যন্ত্রের, যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং যত শিগগির সম্ভব অনুকরণ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। (ইউরোপ) ভ্রমণ করেছেন এমন একজন শিক্ষিত, এশিয়ান প্রাচ্যের জ্ঞানরাজির প্রশংসা এবং এশীয় সভ্যতার ঐতিহ্যগত উৎকর্ষের কথা শুনতে যত বিরক্ত হবেন, তেমনটি আর কিছুতেই হবেন না। বালককে পুতুলের বদলে খেলনা মোটর দিলে যে পরিমাণ খুশী হয়ে ওঠে, তিনিও আসল মোটর পেলে তার শরীরের উপর দিয়ে চলে যেতে পারে সে কথা উপলব্ধি না করে খেলনা মোটর পাওয়া শিশুর মতো খুশী হয়ে উঠবেন।
প্রতীচ্যে মুষ্টিমেয় কবি এবং নন্দনতাত্বিক ছাড়া অন্য সকলের চোখে প্রথমাবস্থায় যন্ত্র একই রকমের আনন্দদায়ক ছিল। উনবিংশ শতাব্দীকে পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোর তুলনায় যান্ত্রিক উৎকর্ষের জন্য উল্লেখযোগ্য বিবেচনা করা হয়। প্রথম জীবনে পিকক (peacock) gosto giusreo syfaro (Steam intellect society) Pos GT করতেন। তিনি ছিলেন সাহিত্যের মানুষ, তার কাছে গ্রিসিয় এবং লাতিন গ্রন্থকারেরা ছিলেন সভ্যতার প্রতীক। কিন্তু তিনি ছিলেন তার যুগের বহতা ভাবধারার প্রতি অত্যধিক সচেতন, কিন্তু যুগের মানুষের কাছে অপাংক্তেয় হওয়ার ভয়ে তা করেছিলেন। রুশোর শিষ্যদের সঙ্গে হ্রদের তীরের কবিরা মধ্যযুগীয় সমস্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকৃতিতে ফিরে গেলেন। উইলিয়াম মরিস (William Morris) তার নিউজ ফ্রম নো হোয়ার (News from nowhere) কাব্যগ্রন্থে এমন একটি দেশের বর্ণনা দিয়েছেন (যেখানে সারাবছর জুন মাস, লোকজন পরমানন্দে তাদের কাজকর্ম গুছিয়ে নিচ্ছে) সবকিছুর মধ্যে একটি খাঁটি আবেগময়তা এবং যান্ত্রিকতার ভাব পরিদৃশ্যমান।
স্যামুয়েল বাটলার ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম নিরুত্তর আবেগে যন্ত্রের বিরোধিতা করেছিলেন, তবে তা তার মধ্যে দ্রুণরূপে বর্তমান ছিল। অন্তরের গভীর শেকড় প্রসার করতে পারেনি। তার সময় থেকে যন্ত্ৰোন্নত জাতিগুলোর কিছুসংখ্যক মানুষ (EREWHONLAN) এরয়ারহোনিয় মতবাদের সমগোত্রীয় একটা মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এই মতবাদ শিল্পোৎপাদন পদ্ধতির প্রতি বিদ্রোহ মনোভাবাপন্ন অনেকের দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রচ্ছন্ন অথবা প্রকাশ্যে ক্রিয়াশীল। যন্ত্রকে পূজা করা হয়, যেহেতু যন্ত্র সুন্দর, দাম দেয়া হয় শক্তিধর বলে, বিকট ভীষণ বলে ঘৃণা করা হয় এবং দাসত্ব ব্যবস্থা কায়েম করে বলে যন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা জ্ঞাপন করা হয়। এর মধ্যে কোন সিদ্ধান্তটা ভালো সে বিষয়ে মন্তব্য করব না, তা করলে মানুষের পা থাকা ভালো, মাথা থাকা খারাপ তাও আমাদের ধারণা করতে হয়। যদিও আমরা সহজে কল্পনা করতে পারি লিলিপুটের মানুষেরা গ্যালিভারের পা মাথা নিয়ে ঝগড়ায় মেতে উঠেছে। যন্ত্র হলো, আরব্যোপন্যাসের সে জ্বীনের মতো প্রভুর কাছে উপকারী এবং সুন্দর, শত্রুর কাছে ভয়াল ভীষণ। কিন্তু আমাদের যুগে কোন কিছুকে উলঙ্গ করে সহজভাবে দেখতে দেয়া হয় না। এটা সত্য যে যেখানে যন্ত্রের ঘর্ঘর শব্দ পৌঁছায়না, অবর্জনার নোংরা স্তূপদৃষ্টিগোচর হয়না, যেখানে দুর্গন্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিতে হয় না, যন্ত্রের মালিকেরা তেমনি নিরাপদ ব্যবধানে বাস করেন। যদি কখনো আসেন তাহলে যন্ত্র চালু হওয়ার আগে যখন তিনি যন্ত্রের শক্তির প্রশংসা করতে পারেন, ধূলোবালি আর উত্তাপে অতিষ্ঠ না হয়ে খুঁটিনাটি দেখে মোহিত হতে পারেন। যারা যন্ত্রের সঙ্গে বাস করেন এবং যন্ত্রে কাজ করে তাদের দৃষ্টিতে যন্ত্রকে বিচার করতে চ্যালেঞ্জ করা হলে সব সময় তারা একই রেডিমেড জবাব দেবেন। তারা বলবেন, যন্ত্র চালু থাকার ফলে তারা বেশি পরিমাণে জিনিসপত্র কিনতে পারছেন। সুতরাং তারা তাদের পিতা পিতামহের চেয়ে অনেক অনেক বেশি সুখী। তা যদি সত্য হয়, সব মানুষে করে এমনি একটা ধারণাকে আমাদের স্বীকার করে নিতে হয়।
ধারণাটা হলো বস্তুগত পণ্যদ্রব্যের অধিকারী হতে পারলে জীবনে সুখী হওয়া যায়। এটাও ধারণা করা যায় যে মানুষের দুটো কক্ষ, দুটো বিছানা এবং দুটো করে রুটি আছে সে মানুষটি একটি কক্ষ, একটি রুটি একটি বিছানা যে মানুষটির আছে তার তুলনায় ঢের বেশি সুখী। মানুষ সব সময়ই ভাবে মানুষের সুখ রুজি রোজগারের উপর নির্ভরশীল। মাত্র কিছু সংখ্যক মানুষ, সেও সব সময় আন্ত রিকতার সঙ্গে নয়, ধর্ম এবং নৈতিকতার নামে এ ধারণার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে থাকেন, আবার তারাও উচ্চ কণ্ঠ প্রচারের মাধ্যমে আয়ের পরিমাণ বাড়াতে পারলে মনে মনে খুব খুশী হন। কোন ধর্ম কিংবা নৈতিকতার বশে নয়, মনস্তত্ত্ব এবং জীবন পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এ ধারণার প্রতিবাদ করতে চাই। জীবনের সুখ যদি রুজি-রোজগারের অনুপাতে হয়ে থাকে তাহলে যন্ত্রের বিপক্ষে বলার আমার কিছু নেই। তা যদি সত্য না হয়ে থাকে তাহলে আগাগোড়া সমস্ত প্রশ্নটা পরীক্ষা করে দেখার অপেক্ষা রাখে।