আমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনার সমাহারের কথা বলতে পারিনে, আমাদেরকে শুধু একটি মাত্র ঘটনা সম্পর্কে বলতে হবে। এই বিরতিকে একজন পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত দুটো ঘটনার পরস্পরের মধ্যবর্তী কিছুটা সম্বন্ধ রয়েছে, যাকে বিরতি বলা যেতে পারে। পর্যবেক্ষক বিভিন্নভাবে নির্দিষ্ট সময় এবং সাময়িক গঠনের নিরিখে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করবে কিন্তু বিশ্লেষণের নিরপেক্ষ মূল্যমানের দাবীদার নয়। বিরতি হলো নিরপেক্ষ বাস্তব ঘটনা কিন্তু তাকে বিভিন্ন উপাদানে খণ্ডিত করলে নিরপেক্ষ বজায় থাকে না।
এটা স্পষ্ট যে, আমাদের নিরেট পদার্থ সম্পর্কে আনন্দিত ধারণা টিকতে পারে না। একখণ্ড পদার্থ নির্দিষ্ট কতেক নিয়মানুসারে সংঘটিত ঘটনা পরম্পরা ছাড়া আর কিছু নয়। পদার্থ সম্পর্কে ধারণা তখনই জাগলো যখন দার্শনিকদের ‘বস্তুর ধারণা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ ছিল না! কাল এবং পাত্রের ব্যাপ্তিতে পদার্থ পদার্থসার এবং শুধু কালের ব্যাপ্তিতে মন বস্তুর সারভাগ রূপে বর্তমান ছিল। দিন গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শনে এই সারভাগের ধারণা ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসে কিন্তু আপেক্ষিকতত্ত্ব আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞনে তা ক্ষতিজনক নয় বৃলে টিকে রইল। বস্তুসারের যে ঐতিহ্যিক ধারণা তা দুরকমের উপাদানে গঠিত হয়েছে। প্রথমতঃ বস্তুসারের ন্যায়শাস্ত্রীয় গুণ অনুসারে কোন প্রতিজ্ঞার কর্তা হিসেবে আসতে পারে, কিন্তু কর্ম হিসেবে নয়। দ্বিতীয়তঃ তা এমন কিছু যা বহুকাল আগে থেকে বর্তমান অথবা ভগবানের ক্ষেত্রে সময়েরও অতীত। এ দুরকমের গুনের মধ্যে কোন প্রয়োজনীয় সম্বন্ধ নেই এবং তা ধারণাও করা হয়নি। কারণ পদার্থবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছে প্রত্যেক খণ্ড পদার্থের মৃত্যু নেই, কিন্তু ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দিয়েছে আত্মার মৃত্যু নেই। সুতরাং উভয় ধারণাতেই সারভাগের বৈশিষ্ট্য বিরাজিত, সে যা হোক বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞান আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে নৈয়ায়িক অর্থে সারবস্তু হলো ক্রমবিলীয়মান ঘটনা। তার মানে সেগুলোকে কর্তা হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিন্তু কর্ম হিসেবে নয়। একখণ্ড পদার্থকে আমরা একটি সত্তা বলে মনে করলেও তা ছায়াছবিতে স্থায়ী লক্ষ্যের মতো অনেকগুলো সত্তার মাখামাখির সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়।মনের সম্পর্কেও একই কথা কেনো বলবোনা আমরা, তার কোন সঙ্গত কারণ নেই। স্থায়ী অহং-এর ধারণা অণুর মতই অলীক। কিন্তু দুটোর মধ্যে শুধু কতকগুলো কৌতূহলোদ্দীপক সম্বন্ধের জট বর্তমান।
আধুনিক পদার্থবিদ্যা ম্যাক (Mach) এবং জেমস (James) এর পরামর্শমতে আমাদের ভাবতে অনুপ্রাণিত করল যে পদার্থজগৎ এবং মানসিকজগৎ একই উপাদানে গঠিত। নিরেট পদার্থ স্পষ্টতঃ ধারনা এবং স্থায়ী অহং থেকে ভিন্নতর ছিল। কিন্তু যদি পদার্থ এবং অহং দুটোর পরস্পর সুবিধাজনক সংমিশ্রণ থেকে সৃষ্টি হতো তাহলো, ও দুটো যে একই উপাদানে সৃষ্টি তা কল্পনা করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। অধিকন্তু আজ পর্যন্ত আত্মগত ধারনা অথবা দৃষ্টিভঙ্গি চিহ্নিত বৈশিষ্ট্যটি বিদ্যমান তা পদার্থবিদ্যাকে যে আক্রমণ করেছে, কিন্তু মনের তেমন চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েনি। বিভিন্ন স্থান থেকে ফটো ক্যামেরার সাহায্যে একই জিনিসের ছবি তোলা হলেও কিন্তু ছবি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হবে। এমনকি ক্রনোমিটার, এবং মাপন দণ্ড ও আধুনিক পদার্থবিদ্যার কর্তপদীয় ভুমিকা গ্রহন করে, সেগুলো প্রাকৃতিক ঘটনার হিসেব না রেখে, প্রাকৃতিক ঘটনার সঙ্গে সম্বন্ধের হিসেব রাখে। এভাবে পদার্থবিদ্যা এবং মনস্তত্ত্ব পরস্পরের দিকে পরস্পর এগিয়ে এসেছে; মন এবং বস্তুর দ্বৈতবাদ ভেঙে পড়েছে
এটা উল্লেখ করা বোধহয় উচিত যে আধুনিক পদার্থবিদ্যা প্রাচীন অথবা পরিচিত অর্থে কোন শক্তিকে স্বীকার করেনা! আমরা আগে চিন্তা করতাম যে সূর্য পৃথিবীতে শক্তি বিকিরণ করছে। এখন আমরা চিন্তা করি কালপাত্রকে সূর্যের আশেপাশে এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে করে অন্য কোন কিছুর বদলে পৃথিবীর ঘুরতে বেশি সুবিধা হয়। আধুনিক পদার্থবিদ্যার অবিসংবাদিত নীতি হলো Principal of least action নীতি। তাহলে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে হলে কোন কিছুর যে পথে ভ্রমণ করতে নূন ক্রিয়া করতে হবে সে পথই পছন্দ করবে। (ক্রিয়া হলো একটি বিষয়গত শব্দ বর্তমান মুহূর্তে তার অর্থের কোন প্রয়োজন আমাদের নেই।) খবরের কাগজের সাংবাদিক এবং অন্যান্য লেখক নিজেদের শক্তিমন্ত দেখতে চায় যারা, তারা গতি শব্দটার খুবই ভক্ত। গতিবিজ্ঞানে গতি বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই। পক্ষান্তরে চিরন্তন অলসতা থেকেই সমস্ত কিছু উৎসারিত সুতরাং অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবয়ব বিশিষ্ট তেমন কিছুর অস্তিত্ব নেই। আধুনিক বিজ্ঞানের যে প্রমাণ তা যারা বিরাট আইন এবং প্রাকৃতিক শক্তির দোহাই পাড়ে তার চেয়ে লাউসের ধারণার অধিকতর নিকটবর্তী। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সমূহবাদী দর্শনের তুলনায় আধুনিক বস্তুবাদী এবং বহুবাদী দর্শনের অবদান অনেক কম। মধ্যযুগে দর্শন ছিল ধর্মতত্বের সেবাদী এবং বর্তমানে দর্শন এক কথায় বই বিক্রেতাদের তালিকায় এসে পৌঁছেছে। সাধারণতঃ ধর্মের মহাসত্যকে প্রমাণ করাই দর্শনের কর্তব্য বলে মনে করা হয়। কিন্তু নব্যবস্তুবাদ সেগুলোকে প্রমাণ অপ্রমাণ কিছুই করার কথা বলে না। শুধুমাত্র বিজ্ঞানের মুল ধারণাগুলো বুঝিয়ে দেয়া, বিভিন্ন বিজ্ঞানের সংশ্লেষ সাধন করে পৃথিবীর যে সকল ক্ষেত্রে বিজ্ঞান নানা অভিযানে সাফল্য অর্জন করেছে তা একটিমাত্র বোধগম্য যুক্তিতে ধরে দেয়াই নব্য বস্তুবাদের লক্ষ্য। পিছনে পড়ে রইল কি, তার সম্পর্কে মাথা ঘামায় না। অজ্ঞতার জ্ঞানে, রূপান্তরিত করার মতো কোন তাবিজ-কবজও নতুন দর্শন দেয় না। যারা বোঝে দাম দেয়, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আনন্দ দিয়ে থাকে, কিন্তু অন্যান্য দর্শনের এত বৃথা অহংকার করে তোষামোদী করে না। যদি তা নীরস এবং বিষয়গত হয়ে থাকে তাহলে ব্রহ্মাণ্ডের উপরে দোষ চাপায় না, কেননা কবি এবং মরমীরা যে রকমটি চায় তার চেয়ে গাণিতিক পদ্ধতিতেই তার ক্রিয়া-কর্ম চলে। হতে পারে তা দুঃখময় কিন্তু একজন গাণিতিক তাতে দুঃখের কিছু খুঁজে পাবেনা।
০৬. যন্ত্র এবং আবেগ
যন্ত্র কি আবেগ সমূহকে হত্যা করবে? না আবেগসমূহ যন্ত্রপাতিকে বিনষ্ট করবে? অনেক আগে স্যামুয়েল বাটলার তার (EREWHON) এয়ার হোন-এ প্রশ্নটির অবতারণা করেছেন। যন্ত্রযুগের ব্যাপক প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।