যদিও শুরুতে নতুন দর্শনের সঙ্গে অন্য যে কোন বিজ্ঞানের চাইতে বিশুদ্ধ গণিতের সম্বন্ধ ছিল অনেক বেশি, তবু বর্তমানে এতে পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাবই অধিক। তা হয়েছে আইনস্টাইনের কর্মের মাধ্যমে। যা স্থান কাল এবং পাত্রের ধারণার মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। আপেক্ষিক তত্ব বিশ্লেষণ করবার স্থান এ নয়, কিন্তু এর কতিপয় দার্শনিক ফলাফল এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে দু’টো বিশেষ আপেক্ষিকবাদ তত্বে দুরকমের বিশেষ উপাদান বর্তমান (১) সর্বব্যাপ্ত এবং সবকিছু ধারণক্ষম এমন কোন কাল নেই যার মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের সকল ঘটনার স্থান সংকুলান হতে পারে। (২) প্রাকৃতিক বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করার সনাতন অথবা আত্মগত ক্ষমতা আগে যেমন কল্পনা করা হতো, যদিও তার চেয়ে অনেক ব্যাপক এবং টেনসর ক্যালকুলাস (Tensor Calculas) নামে একজাতীয় আঙিক পদ্ধতিতে তা দেখানো যেতে পারে। আমি পরবর্তী বিষয় সম্পর্কে কিছু বলতে চাইনে, কারণ তা অসহনীয়ভাবে দুর্বোধ্য এবং বিষয়াগত।
গবেষণালব্ধ ফলাফলের প্রয়োজনে গাণিতিক ফর্মূলানির্ভর একটি থিয়োরির মাধ্যমেই সময়কে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, প্রাথমিকভাবে দর্শনের দূরবীক্ষণের ওপর নির্ভর করলে আমাদের চলবে না। মন্টেসকুর (Montesquieur) থিয়োরি এবং আমেরিকার সংবিধানের মধ্যে যে পার্থক্য এ দুয়ের পার্থক্যও তেমনি। দৃষ্টিতে যা পড়ে তা হলো, কোন নির্দিষ্ট পদার্থে যখন কোন ঘটনা ঘটে তখন যে দর্শক তার গতিতে অংশগ্রহণ করে তার দৃষ্টিভঙ্গীতে একটি নির্দিষ্ট সময় সঙ্গতি ধরা পড়ে। কিন্তু বিভিন্ন পদার্থের বিভিন্নস্থানে যে ঘটনা ঘটে সকল অবস্থার সময় সঙ্গতি মেনে চলে না। সংক্ষেপে বলতে গেলে পৃথিবী থেকে সূর্যে আলোক সঙ্কেত প্রেরণ করে আবার যদি পৃথিবীতে ফেরত আনতে হয়, তা হলে তা প্রেরণ করার প্রায় ষোল মিনিট পরে ফিরে আসবে। এই ষোল মিনিট সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে যে সকল ঘটনা ঘটবে তা আলোক সঙ্কেত ফিরে আসার পরে বা পূর্বে ঘটবেনা। আমরা যদি কল্পনা করি পর্যবেক্ষকেরা সূর্য এবং পৃথিবীর সকল সম্ভাব্য দিকে ঘুরে ঘুরে ঐ ষোল মিনিটে পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনা এবং সূর্যের থেকে প্রত্যাগত আলোক সঙ্কেতের দিকে লক্ষ্য করছে, এবং আমরা যদি ধরে নেই যে আলোর গতিবেগ সম্পর্কে হিসেবে রাখার জন্য নিখুঁত ক্রনোমিটার যন্ত্র ব্যবহার করতে দেয়া হলো তাহলে কোন কোন পর্যবেক্ষক ঐ ষোল মিনিটের মধ্যে পৃথিবীর কোন ঘটনাকে সূর্যপ্রত্যাগত আলোকসঙ্কেতের পূর্ববর্তী, কেউ একই সময়ে এবং কেউ পরে ঘটেছে বলে বিচার করবে। তারা সকলেই সমানভাবে সত্য অথবা সমানভাবে মিথ্যা। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের নের্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে পৃথিবীর ঘটনা সূর্য থেকে আলোক সঙ্কেত নিয়ে আসার আগে পরে, কিংবা এক সময়েও ঘটেনি। ঘটনা কোন পদার্থের আগে ঘটল এবং যে ঘটনা অন্য কোন পদার্থে পরে ঘটল যদি ক থেকে খ তে আলোক সঞ্চালিত হতে না পারে তা হলে আমরা বলতে পারবো না ক এর ঘটনা (ক এর সময়ক্রম অনুসারে) পূর্বে ঘটেছে খ এর ঘটনা ক এর ঘটনার প্রতিক্রিয়ার ফলে (খ এর সময়ক্রম অনুসারে) পরে ঘটেছে। তা না হলে দুটো ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেনা।
আমরা আলো সম্পর্কে যে মামুলি ধারণা পোষণ করি গতি যদি তার সঙ্গে তুলনীয় হতো তাহলে বস্তুবিশ্বকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিচার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত এবং আজকের যুগ পর্যন্ত আমাদের প্রারম্ভিক যুগের চিকিৎসকদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো! পদার্থ বিদ্যার কিছু আবিষ্কার হয়েছে একথা বললে আইনস্টাইনের নাম না করে উপায় নেই, কেননা তার আবিষ্কার ব্যতিরেকে নিউটনিয় পদার্থবিদ্যা অফলিত থেকে যেত। তেজস্ক্রিয় পদার্থের যে কণিকাসমূহ বিচ্ছুরিত হয় তার গতিবেগ প্রায়ই আলোর গতিবেগের সমান এবং এ কণিকাসমূহের প্রকৃতি পদার্থ বিদ্যার নতুন আপেক্ষিক গুরুত্বের সাহায্য ছাড়া বোধগম্য হয়ে উঠে না। পুরনো পদার্থবিদ্যা যে প্রমাদপূর্ণ তাতে কোন সন্দেহ নেই এবং দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে দোষ অল্প বলাটা কোন একটা কৈফিয়ত নয়। আমাদের মনকে কিছু অংশে এ বিশ্বাসে তৈরি করে নিতে হবে যে, বিভিন্নস্থানে যে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে তার মধ্যে নির্দিষ্ট কোন সময় সঙ্গতি নেই। এই একটি কারণে কাল এবং পাত্র দু’টো আলাদা বহুবিন্যাসের বদলে কালপাত্র একটি বহুবিন্যাসের (Multifold) প্রবর্তন করা হয়েছে। যে সময়কে আমরা মহাজাগতিক মনে করি আদতে তা লোক্যাল টাইম বা স্থানীয় সময় যা পৃথিবীর সঙ্গে আটলান্টিক পাড়ি দেয়া জাহাজ যেমন ঘড়ি বদলায় না তেমনি একান্তভাবেই সম্পৃক্ত।
আমাদের স্বাভাবিক ধারণাতে সময়ের ভূমিকাই সকল কিছু বলে যখন আমরা বিবেচনা করি, আমরা কাল্পনিকভাবে হলেও পদার্থবিদেরা যা করেছে, তা বুঝতে পারি যদি, তাহলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে যে আমূল পরিবর্তন আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রগতির ধারণার কথাই বলা যাক না, যদি সময়সঙ্গতি কোন নিয়ম মেনে না চলে তাহলে সময়কে মাপার যে পদ্ধতি অবলম্বিত হবে সে অনুসারে প্রগতি অথবা প্রতীপগতি নির্ধারিত হবে। যদি দু’জন পর্যবেক্ষক দু’স্থান থেকে একটি নির্দিষ্ট স্থানের দূরত্ব নিখুঁতভাবে নির্ণয় করার জন্য সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বন করে থাকে এবং তাদের গতি আপেক্ষিকভাবে দ্রুত হয়, তাহলে পর্যবেক্ষকরা দূরত্ব সম্পর্কে আলাদা আলাদা সিদ্ধান্তে উপনীত হবে, এভাবে দূরত্বের ব্যাপ্তির ধারণারও তারতম্য ঘটে। দূরত্ব নিশ্চিতভাবে বাস্তব পদার্থের মধ্যবর্তী শূন্যের মধ্যে নয় বলে দূরত্বের ধারণাও ঝাপসা হয় এবং তা পরিষ্কার বোঝা যায়। দূরত্বটা কোন বিশেষ সময়ের কেননা দুটি পদার্থের মধ্যে ক্রমাগত দূরত্বের পরিবর্তন ঘটেছে এবং নির্দিষ্ট সময় হলো আত্মগত ধারণা, পর্যবেক্ষক যে পথে প্রথম ভ্রমণ করেছে তার উপর নির্ভরশীল।