একইভাবে ন্যায়শাস্ত্রে আঙ্গিক মতবাদের স্থলে পরমাণুবাদকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কোন বিষয়ের সঙ্গে কোন বিষয়ের সম্বন্ধের ফলে তার অভ্যন্তরীণ প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে, সে কারণে ভাবা হতো কোন বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান থাকলে সমগ্র বিশ্ব সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান অর্জন করা যায়। নতুন দর্শন অনুসারে কোন বস্তু সম্পর্কে প্রাজ্ঞ ধারণা ন্যায়শাস্ত্রমতে সে বস্তুর সঙ্গে অন্য বস্তুর সম্বন্ধ নিরূপন করতে আমাদের অনুপ্রাণিত করে না। একটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। লাইবনিজ Leibnitz মনে করতেন (এ ব্যাপারে তিনি আধুনিক আদর্শবাদীদের সঙ্গে একমত) কোনো লোক ইউরোপে থাকলে এবং ভারতে তার স্ত্রীর মৃত্যু হলে স্ত্রীর মৃত্যুর মুহূর্তে তার মধ্যে অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার হবে। সাধারণ জ্ঞান বলে যে মৃত্যুর সংবাদ না শোনা পর্যন্ত তার মধ্যে কোন গভীরতর পরিবর্তন অসম্ভব। নতুন দর্শনে এই মতবাদকে গ্রহণ করা হয়েছে এবং এর ফলাফল প্রথমে যা মনে হয়েছিল তার চেয়ে অনেক সুদূরপ্রসারী।
অঙ্কের মৌলনীতির সঙ্গে সবসময়ে দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্বন্ধ রয়েছে। অঙ্ক দৃশ্যতঃ অধিক পরিমাণে পূর্ববর্তী নিশ্চিত জ্ঞান পরিবেশন করে এবং অধিকসংখ্যক দর্শনে পূর্ববর্তী জ্ঞানের প্রাধান্য বর্তমান। জেনোর (Zeno) সময় থেকে একটি আদর্শবাদী সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা, অঙ্ক সত্যিকার দার্শনিক উপনিত হতে সমর্থ এবং দার্শনিকেরা অধিকতর সুস্থ জ্ঞান পরিবেশন করতে পেরেছে বলে মনে করত। এর মধ্যে কান্টের দর্শন অনেক পরিমাণে এবং হেগেলের দর্শন আরো বেশি পরিমাণে প্রতিফলিত হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে অঙ্কবিদেরা কান্টের দর্শনের এ অংশকে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে ফেলেন। লোবাত চেভস্কি (Lavat Chvoski) নন ইউক্লিডিয়া জ্যামিতির আবিষ্কার করে কান্টের অঙ্কভিত্তিক যুক্তির লোকোত্তর সৌন্দর্যতত্ত্বের প্রাধান্য খর্ব করে ফেলেন। ওয়েবার স্ট্রস (Wabre strass) প্রমাণ করলেন অতি ক্ষুদ্রতম রাশির মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন প্রসারমানতা অনুপস্থিত। জর্জ কেন্টোর একটি প্রসারমানতা এবং একটি অসীমতার থিয়োরি আবিষ্কার করে প্রাচীন আপাতঃবিরোধী সত্য, যেগুলোর উপর দার্শনিকেরা পরস্পর বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তা সমাধান করে ফেলেন! ফ্রেজ (frege) দেখালেন যে পাটিগণিত ন্যায়শাস্ত্রকেই অনুসরণ করে, কিন্তু কান্ট তা অস্বীকার করেছেন। সাধারণ আঙ্কিক পদ্ধতিতে এ ফলসমূহ অর্জিত হয়েছে এবং গুণের টেবিলে করলে যেমন হতো তেমনি নিখুঁত এবং নির্ভুল। গ্রন্থাকারদের লেখা পড়ে দার্শনিকেরা এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি। নতুন দর্শন শুধু নতুন ফলশ্রুতির সমন্বয় সাধন করে ধারাবাহিক অজ্ঞতার ধারক বাহকদের উপর সহজ বিজয় অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে।
নতুন দর্শন শুধু সমালোচনামূলক নয়, বিজ্ঞান যেমন পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা মূলকভাবে গঠনমূলক, এও তেমনি গঠনমূলক। আঙ্কিক ন্যায়শাস্ত্র নামে এর একটা আলাদা গঠনপদ্ধতি রয়েছে, যা অন্যান্য ঐতিহ্যিক শাখার চাইতে অধিকতর দর্শনেরই সমগোত্রীয়। কোন বৈজ্ঞানিক মতবাদের দার্শনিক প্রতিক্রিয়া কি, আগে তা নিরূপন করা সম্ভব ছিল না। তাদের মধ্যে বাস্তব ভিত্তি কি এবং সম্পর্ক কি তার নির্ধারণ আঙ্কিক ন্যায়শাস্ত্র সম্ভব করে তুলেছে। এই পদ্ধতির সাহায্যে পদার্থবিদ্যা এবং অঙ্কবিদ্যার দর্শনের প্রচুর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ডক্টর হোয়াইটহেড তার সাম্প্রতিক তিনটি গ্রন্থে পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটেছে তা পেশ করেছেন। অন্যন্য বিষয়েও পদ্ধতি যে সমানভাবে ফলপ্রসু প্রমাণিত হবে তা বিশ্বাস করার কোন সঙ্গত কারণ নেই, এবং তা অত্যন্ত ঘঘারালো প্যাচালো বলে এখানে উদ্ধৃত করা গেল না।
অনেক আধুনিক বহুবাদী দার্শনিক বক্তব্যের ন্যায়শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। প্রথমে এ পদ্ধতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাসহকারে ব্যাকরণে প্রয়োগ করা হয়েছিল। মেনং (Meinong) দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন, যখন আমরা গোলাকার এবং বর্গাকার কোনকিছু একথা বলতে পারি সহজে তখন অস্তিত্বহীন হলেও গোলাকার এবং বর্গাকার কোনকিছু সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে আমরা ধরণা পোষণ করি। বর্তমান প্রবন্ধের লেখকও এ ধরণের ধারণা পোষণ করা থেকে মুক্ত ছিলেন না, কিন্তু ১৯০৫ সালে বর্ণনাতত্ত্বের সাহায্যে কিভাবে সে ধরণার নিরসন ঘটাতে হয় তা আবিষ্কার করে। গোলাকার এবং বর্গাকার কোন কিছুকে নির্দেশ করা হয় না। একইসঙ্গে গোলাকার বর্গাকার কোন হাস্যকর বস্তুতে সময় নষ্ট করা উদ্ভট ঠেকে কিন্তু এরকম বিষয়সমূহ অনেক সময় ন্যায়শাস্ত্রের পরীক্ষার পরও টিকে থাকে। অধিকাংশ ন্যায়শাস্ত্রীয় তত্ত্বের নিন্দা করা হয়; কারণ সেগুলো অস্পষ্টতার দিকে টেনে নিয়ে যায় সুতরাং নৈয়ায়িকদের অস্পষ্টতা সম্বন্ধে সজাগ এবং নিরসনের উপায় সম্বন্ধে হুঁশিয়ার হতে হবে। যাদের প্রাসঙ্গিক জ্ঞান নেই তাদের কাছে গবেষণাগারে পরীক্ষালব্ধ ফলকেও তুচ্ছ মনে হবে এবং অস্পষ্টতা হলো নৈয়ায়িকদের জন্য হাতে-কলমে পরীক্ষা নিরীক্ষা বিশেষ।
বক্তব্যের নৈয়ায়িক বিশ্লেষণের পূর্ববর্তী প্রভাবের দরুন সর্বপ্রথম নতুন দর্শনে নিষ্কাম দর্শন এবং মধ্যযুগীয় বস্তুবাদের জোরাল একটি সংমিশ্রণ ঘটেছিল যা বাস্ত বের মতো বিমূর্ত সবকিছুর অস্তিত্বেও বিশ্বাস করত। এই ভঙ্গি থেকে ন্যায়শাস্ত্র অধিকতর পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং অধিকতর স্বাধীন হয়ে পড়ে। বাকি যা থাকে তা আমাদের সাধারণজ্ঞানকে মুছাহত করার এত মারাত্মক তেমন কিছু নয়।