নির্বচিত শব্দগুলোকে বাদ দিলে বের্গসঁ তার দর্শনের এ অংশ প্লাটিনাসের (Plotinus) সঙ্গে নতুন কিছু সংযোজন করেন নি। নির্বাচিত শব্দসম্ভার আবিষ্কার করা নিঃসন্দেহে ক্ষমতার পরিচায়ক, কিন্তু দার্শনিকের চাইতে কোম্পানির পদোন্নতিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরাই সেজন্যে অধিক লালায়িত। যা তাকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করেছিল, তা তার দর্শনের কোনও অংশবিশেষ নয়। তিনি তার মতবাদকে প্রাণবন্ত এবং অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করতেন। তার শ্রেষ্ঠতম এবং উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো, তিনি মরমীবাদের সঙ্গে সময়ের প্রগতির বিশ্বাসের সংশ্লেষ ঘটিয়েছেন। এতে তিনি কি পরিমাণ সাফল্যলাভ করেছেন তা আমাদের দেখা উচিত। প্রাত্যহিক মরমীবাদ ধ্যানশীলতার উপর নির্ভরশীল, যা সময়ের অনিত্যতা সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে, তা নিঃসন্দেহে অলস মানুষের দর্শন বলে আখ্যা পেতে পারে। আত্মার গহণ রাত হলো মরমীবাদের উজ্জ্বল গৌরচন্দ্রিকা, যা কোন মানুষের মধ্যে তখনই উদয় হয় যখন একজন মানুষ নৈরাশ্যজনকভাবে কর্মবিমুখ হয়ে পড়ে অথবা আকস্মিকভাবে বাস্তবকর্মের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে বসে। কর্মচাঞ্চল্য দ্বারা চালিত হলে কোন ধ্যানের দরকার পড়ে না। আমাদের সাধারণ নিয়ম হলো, সম্ভব হলে আমরা সে সকল বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকি যা আমাদের আত্মসম্মানকে অক্ষণ রাখে। মনঃসমীক্ষা সাহিত্য এ ধরনের উদ্ভট দৃষ্টান্তে ভরপুর। যে ব্যক্তি ধ্যানে আত্মনিয়োগ করেছে আপাততঃ তাদের চোখে ধ্যানই জীবনের সত্যিকার পরিণতি এবং যারা জাগতিক ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত থাকে তাদের দৃষ্টিকোণ সত্যিকার জগতের ছবি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে না। এই ভিত্তিতে ঐতিহ্যিক মরমীবাদের বাকি মতবাদসমূহ সম্বন্ধে স্থির সিদ্ধান্তে আসা যায়। শ্রেষ্ঠ মরমীদের মধ্যে বোধহয় লাওসে প্রথম, যিনি কাস্টম হাউজে তার মালপত্র পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করার সময় বই লিখে ফেলেছিলেন। যেমনটি প্রত্যাশিত ছিল তার বইয়ের সর্বত্র-কর্ম যে কিছু নয়, সে মতবাদে ভরপুর।
কিন্তু বের্গসঁ মরমীবাদকে কর্ম এবং জীবন বিশ্বাসীদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করেছিলেন, যারা বাস্তবতার প্রগতিতে বিশ্বাসী কোন ক্রমেই ধরাপৃষ্ঠে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিস্পৃহ ধারণা পোষণ করতে পারে না। মরমীরা হচ্ছে প্রবৃত্তিগতভাবে নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে ডুবে যাওয়া সক্রিয় মানুষ আর প্রাণবাদীরা হচ্ছে কর্মের প্রতি রোমান্টিক প্রশংসা পোষণকারী নিষ্ক্রিয় মানুষ। ১৯১৪ সনের আগে পৃথিবী এরকম মানুষে পরিপূর্ণ ছিল। তাদের প্রবৃত্তির ভিত্তিস্থল ছিল বিতর্কিত এবং সংশয়বাদ ভালোবাসার উত্তেজনা এবং অযৌক্তিক একটি ধর্মের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করত, তারা মনে করত তাদের কর্তব্য হলো মানুষকে মানুষ হত্যা করার জন্য অনুপ্রাণিত করা এবং তাদের এ লালিত বিশ্বাসের ক্ষেত্রভূমিতেই সে ধর্মের সন্ধান পেয়েছিল। ১৯০৭ সালে তাদের কোন নির্গমণ পথ ছিল না, কিন্তু বের্গ একটি উত্তম বিকল্পের ব্যবস্থা করেছিলেন।
বের্গসঁর মতবাদ মাঝে মাঝে এমন ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে যা ভুলপথে নিয়ে। যেতে পারে, তার কারণ হলো, যে সকল জিনিসকে তিনি কাল্পনিক মনে করেছেন তা অনেক সময় বাস্তবের মতো মনে হবে। তার মতামতের ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা এড়িয়ে যেতে পারলে সময় সম্পর্কে তার মতামত নিম্নরূপঃ ধারাবাহিকভাবে কতকগুলো মুহূর্ত অথবা ঘটনার সমাহার নয়, সময় নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রসারমান, যার মধ্যে ভবিষ্যৎকে পূর্বাহ্নে দেখা যায় না; কেননা তা সম্পূর্ণভাবে নতুন এবং অকল্পনীয়। যা কিছু সত্যিকারভাবে ঘটে থাকে তার সমস্ত কিছু গাছের কাণ্ডের প্রত্যেকটি বলয়চিহ্নের মতো রক্ষিত থাকে। (এটা তার বাড়িয়ে বলা নয়। সুতরাং পৃথিবী চিরাচরিত ভাবে পূর্ণতা এবং সমৃদ্ধির পানে এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজের অবাস্তব স্মৃতির তুলনায় যা কিছু বাস্তব জীবনে ঘটে থাকে প্রকৃত সজ্ঞা বা ইনটুইশনের দর্পণে বর্তমান তাকে। অপরিবর্তনশীলতা হলো ব্যাপ্তি এবং নতুন কিছু করার উত্তেজনাকে বলা হয় প্রাণশক্তি-সজ্ঞা যা ইনটুইশনের সত্যিকারের স্মৃতির অন্বেষণ করা আত্মশৃঙ্খলার ব্যাপার; তা কিভাবে করা হবে, তা তিনি আমাদেরকে বলে দেননি। যোগীরা যে পদ্ধতিতে তা করে থাকেন, তিনি ওরকম কোন পদ্ধতির কথা বলে থাকবেন, এরকম সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
যদি কেউ ন্যায়শাস্ত্রের মতো সামাজিক বিষয়ে বের্গসঁর দর্শনকে প্রয়োগ করার দুঃসাহস করে তাহলে পরিবর্তিত দর্শনের মধ্যে কতিপয় অসুবিধা দেখা যাবে। সময়কে ধারাবাহিক অনুক্রম এবং বিভিন্ন অংশকে বাহ্যিক বলে বিবেচনা করার জন্যে বের্গসঁ অঙ্কবিদদের অক্লান্তভাবে তিরষ্কার করেছেন। আদতে যদি পৃথিবীতে সত্যিকার মহত্ত্ব বলতে যেমন তিনি বলেছেন তেমন কিছু থাকে (যে দিকটি ছাড়া তার দর্শন আকর্ষণীয় গুণপনা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়বে। পৃথিবীতে যা আসে স্থায়ী হয়। (যা তার ব্যপ্তিবাদ দর্শনের সরল তাৎপর্য) তাহলে অতীতের যে কোন অস্তিত্বের যোগফল পরবর্তীকালের যে কোন যোগফলের সমান হবে। সম্পূর্ণ এবং অংশবিশেষের সম্বন্ধ অনুপাতে বিভিন্ন যুগে পৃথিবীর সমূহ অবস্থার মধ্যে এ গুণের অনুক্রম প্রকাশিত এবং এই অনুক্রমের মধ্যে অংকবিদেরা আকাক্ষিত গুণসমূহ খুঁজে পান। কিন্তু বের্গসঁ সেগুলোকে নির্বাসনে পাঠাতে চান। পৃথিবীর পরবর্তী অবস্থার যে সকল উপাদান সংযোজিত হয়েছে, তা যদি প্রাচীন উপাদানের বাহ্যিক সংযোজন না হয়, তাহলে বলতে হয় সত্যিকারের কোন মহত্ব নেই, সৃষ্টিশীল বিবর্তন কিছুই সৃষ্টি করে নি এবং আমরা আবার প্লাটিনাসের পদ্ধতিতে ফিরে এসেছি। অবশ্য এ দ্বিমূখী সমস্যার বের্গসঁ উত্তর দিয়েছেন যে জন্মের ফলে সবকিছুতে পরিবর্তন আসে কিন্তু তারপরেও তা একই রকম থেকে যায়। সে যা হোক, তার এ ধারণা বড় রহস্যময়; তা ভেদ করা বিধিনিন্দুক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মূলত বের্গর্সর আবেদন মরমি ধর্মে, যুক্তিতে নয়, কিন্তু যেখানে তার ধর্ম যুক্তির দিগন্তের বাইরে সেখানে আমরা তাকে অনুসরণ করতে পারিনে।