ধর্ম এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রায় সবসময় এমন সব মতামত গ্রহণ করা হয় যার সঙ্গে আবেগের সুগভীর অন্বয় বর্তমান চীনদেশ ছাড়া অন্যান্য দেশে এসব বিষয়ে জোরালো বক্তব্য যদি কোন মানুষের না থাকে তাহলে তাকে খুবই হতভাগ্য মনে করা হয়। মানুষ তাদের বিপরীত মনের আবেগবান সমর্থকদের যত বেশি ঘৃণা করে, তারও চেয়ে বেশি ঘৃণা করে সংশয়বাদীদের। এসব ব্যাপারে বাস্তব জীবনের দাবিতে যে সকল মতামতের প্রয়োজন হয় তা অতিযুক্তিবাদী হয়ে গেলে সামাজিক জীবন অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমি বিশ্বাস করি এর বিপরীতে বিশ্লেষণ করলে, আমার এ মতামতকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
১৯২০ সালের বেকার সমস্যার কথা ধরা যাক। এক পার্টির মতে ট্রেড ইউনিয়নের অন্যায়ের ফলে তা হয়েছে, অন্য পার্টির মতে মহাদেশের বিশৃঙ্খলার কারণেই তা ঘটেছিল। তৃতীয় পার্টি এ সকল কারণ মেনে নিয়ে অধিকাংশ দোষ ইংল্যাণ্ডের ব্যাঙ্কের ঘাড়ে চাপিয়েছিল, যেহেতু ইংল্যাণ্ডের ব্যাঙ্ক পাউণ্ডের মান বৃদ্ধি করেছিল। আমি জানতে পেরেছি যে এই তৃতীয় পার্টির মধ্যে সকলেই ছিলেন বিশেষজ্ঞ, আনাড়ি কেউ ছিলেন না। পার্টির বক্তৃতায় যে মতামতকে প্রকাশ করা যায় না, সে মতামতে রাজনৈতিক ব্যক্তি কোন আগ্রহ পোষণ করেন না। যে সকল মতামত বিরুদ্ধপক্ষীয়দের দুর্ভোগের কারণ হয়ে থাকে, সে সকল মতামতকেই সাধারণ মানুষ পছন্দ করে বেশি। ফলতঃ মানুষ অসার মতামতের পক্ষে-বিপক্ষে সংগ্রাম করে। পক্ষান্তরে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বলে অল্পসংখ্যক মানুষ, যাঁদের যুক্তিনিষ্ঠা রয়েছে, তাদের কথার কেউ কর্ণপাত করে না। মতে দীক্ষিত করতে গেলে ইংল্যান্ডের ব্যাঙ্ক যে খারাপ এ কথা বোঝাতে হবে। শ্রমিক দলীয়দের আস্থা অর্জন করতে গেলে ব্যাঙ্ক অব ইংল্যাণ্ডের ডিরেক্টরদের ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধবাদী বলে দেখাতে হবে। লণ্ডনের ধর্মাধ্যক্ষের সমর্থন পাওয়ার জন্য এ সকল কাজকে নৈতিকতাবিরোধী দেখাতে হবে। মুদ্রা সম্পর্কে তাদের যে মতামত সত্য নয়, এমন মতবাদেও বিশ্বাস করতে হবে।
আর একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, সমাজতন্ত্রবাদ মানবপ্রকৃতির পরিপন্থী। আবার সমাজতন্ত্রবাদীরাও তাদের বিরুদ্ধবাদীর বিপক্ষে এই উত্তপ্ত অভিযোগ করে থাকেন। পরলোকগত ড. রিভার্স (Dr. Rivers) বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের একটি বক্তৃতায় এ প্রশ্নের আলোচনা করেছেন, যা পরে তার মূল্যবান বই ‘মনোবিজ্ঞান এবং রাজনীতিতে (Psychology and Politics) প্রকাশিত হয়েছে। আমার জানামতে এটিই হচ্ছে একমাত্র আলোচনা, যা বৈজ্ঞানিক বলে দাবি করতে পারে। কতিপয় নৃতাত্ত্বিক উপাদানের উপর নির্ভর করে দেখাতে চেয়েছিলেন যে মেলানেশিয়াতে (Melanesia) সমাজতন্ত্রবাদ মানবপ্রকৃতির পরিপন্থী নয়। পরে তিনি অবশ্য বলেছেন যে মানুষের প্রকৃতি মেলানেশিয়াতে যেমন ইউরোপেও তেমন কি না আমরা জানিনা। উপসংহারে তিনি মন্তব্য করেছেন যে ইউরোপের মানুষ প্রকৃতির পরিপন্থী কিনা আবিষ্কার করার চেষ্টা হলো এটি : এটি খুবই কৌতূহলপ্রদ যে এই উপসংহারের উপরই ভিত্তি করে তিনি শ্রমিকদলের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে তিনি রাজনৈতিক বিতণ্ডার মধ্যে যে পরিমাণ উত্তাপ এবং আবেগ জড়িত থাকে নিশ্চিতভাবে তা ঘটতে দেন নি।
এখন আমি এমন একটি বিষয়ে আলোচনা করার দুঃসাহস করছি যা মানুষ নিরুত্তপ্ত আবেগে দেখতে অধিকতর অসুবিধার সম্মুখীন হয়। সে বিষয়টি হলো বিবাহরীতি। প্রতিটি দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে যে নিজের দেশের বিবাহপদ্ধতি ছাড়া আর সবরকমের বিবাহপদ্ধতি নীতিসম্মত নয়। যারা এ মতামতের বিরোধিতা করে, সাধারণতঃ আপনাপন অনিশ্চিত জীবনের খাতিরেই করে থাকে। ভারতে বিধবাদের পুনরায় বিবাহের কথা চিন্তা করাই হলো জঘণ্য অপরাধ। ক্যাথলিকপ্রধান দেশে বিবাহ বিচ্ছেদকে খুবই মন্দ কাজ বলে গণ্য করা হয়, তবে অন্ততঃ পুরুষের ব্যাপারে যৌথজীবনের সততা বজায়ের কিছু অক্ষমতাকে বরদাশত করা হয়। আমেরিকাতে বিবাহ বিচ্ছেদ খুবই সহজ, কিন্তু বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ভয়ঙ্করভাবে নিন্দিত হয়। মুসলমানেরা বহুবিবাহে বিশ্বাসী, অথচ আমরা চূড়ান্ত নিন্দনীয় মনে করি। এ সকল বিপরীত মতামতকে অপ্রতিরোধ্য এবং চূড়ান্ত বলে ধরে নেয়া হয় এবং যারা এর বিরোধিতা করেন, তাদের উপর নির্মম নির্যাতন করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন দেশের কেউ প্রমাণ করতে চেষ্টা করে না যে তাদের আচারপদ্ধতি অন্যদের আচারের চাইতে মানুষের সুখ সমৃদ্ধির খাতিরে নতুন কিছু দান করেছে।
এ বিষয়ে যখন আমরা বৈজ্ঞানিক আলোচনা (উদাহরণস্বরূপ) ওয়েস্টার ম্যাক (Westermack) এর মানবজাতির বিবাহের ইতিহাসের (History of Human Marriage) এর মতো বইয়ের পাতা খুলে দেখি, আমরা এমন একটি আবহাওয়ার সাক্ষাৎ পাই যা সম্পূর্ণভাবে প্রচলিত কুসংস্কার থেকে ভিন্নরকম। আমরা দেখতে পাই যে যত রকমের আচার-পদ্ধতি প্রচলিত আছে, তার মধ্যে অনেকগুলো মানবপ্রকৃতির পক্ষে ক্ষতিকর বলে অনেকসময় আমরা মনে করে থাকি। বহুবিবাহ বলতে আমরা মনে করি পুরুষেরা জোর করে নারীদের উপর এ অত্যাচারের বোঝ চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তিব্বতীয়দের আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে কি মনে করবো। তিব্বতীয় রীতি অনুসারে একজন নারীর অনেকগুলো স্বামী থাকতে পারে। তিব্বতে যারা ভ্রমণ করেছে, তারা নিশ্চিত ভাবে এ কথাই বলেছে যে সেখানে পারিবারিক শান্তি শৃঙ্খলা অন্ততঃ ইউরোপের মতো আছে। এরকম কিছু পড়াশোনার পরে যে কোন সরলমনা মানুষই সংশয়বাদীতে পরিণত হবেন, কারণ এক জাতীয় বিবাহ যে অন্য জাতীয় বিবাহের চেয়ে ভালো বা মন্দ, হাতের কাছে তার প্রমাণ করবার মালমশলা নেই। নিজেদের বিধিনিষেধের প্রতি যারা অশ্রদ্ধেয় মনোভাব পোষণ করে, সাধারণত তাদের প্রতিশোধ গ্রহণ করার সবটুকুতেই নির্মমতা এবং অসহনশীলতা বর্তমান। অন্যথা তাদের মধ্যে কোনকিছুরই মিল নেই। এ থেকে মনে হয় মানুষের পাপ ভৌগোলিক। এই উপসংহার থেকে একপদ অগ্রসর হয়ে নতুন উপসংহারে পৌঁছলে বুঝতে পারবো যে মানুষের পাপের সেই কাল্পনিক পাপীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য যে নির্দয়তা নির্মাতা এখনো প্রচলিত আছে, তার প্রয়োজন নেই। এই উপসংহারটি অনেকের মনে তেমন আনন্দ দেবে না, কারণ সুস্থ বিবেকে নির্দয়তার চর্চা করা নীতিবাগীশদের জন্য খুবই আনন্দদায়ক। সে জন্যে তারা নরক আবিষ্কার করেছে।