সে যাহোক, বাস্তবে প্রয়োগবাদের একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর দিক রয়েছে। এ মতবাদ অনুসারে বিশ্বাসের আকারে যা পুরস্কৃত করে, তাই সত্য। এখন কথা হলো ফৌজদারি আইনের প্রয়োগ করেও একটি বিশ্বাসের দাম হাসিল করা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ক্যাথলিক মতবাদ ক্যাথলিক দেশে এবং প্রোটেস্টান্ট মতবাদ প্রোটেস্টান্ট দেশে দাম পেয়েছে। উৎসাহী মানুষ রাষ্ট্রের সরকারযন্ত্র করায়ত্ব করে নিজস্ব মতামত ছাড়া অন্যন্য মতবাদকে নির্যাতন করে সত্যের উৎপাদন করতে পারে। বাড়াবাড়ির ফলে এ পরিণতি ঘটে এবং প্রয়োগবাদ সম্পূর্ণবাবে এ আওতায় পড়েছে।
প্রয়োগবাদীরা যা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে, সত্য পরিমাণ মতো এবং মানবিক ঘটনাবলীর সম্পদ বিশেষ তা মেনে নেয়ার পরও সম্পূর্ণভাবে মানবিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত বিশ্বাসে যে পরিমাণ সত্য থাকে অন্যান্য রকমের বিশ্বাসে সে পরিমাণ সত্যের নির্যাস থাকে না। আমাদের বিশ্বাস সমূহে সত্যের পরিমাণ বাড়াতে হলে আমাদেরকে একটা আদর্শের কল্পনা করতে হয় এবং যদি বাস্তব ঘটনার সাহায্যেই আদর্শের প্রতিষ্ঠা করা হয় তবে এ ব্যাপারে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার পরিধি খুবই সঙ্কীর্ণ; কোন গ্রহপূষ্ঠের অথবা গ্রহের নিকটস্থ কোন ঘটনার খুঁটিনাটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞাপনদাতাদের কৌশল থেকেই প্রয়োগবাদের উৎপত্তি, যারা বারবার তাদের একবাক্স পিনের দাম এক গিনি প্রচার করার ফলে মানুষ ছয় পেন্স প্রদান করতে রাজি হয়। কম আত্নবিশ্বাস নিয়ে প্রচার করলেও তাদের কথা প্রায়ই সত্যের আকার ধারণ করে। এ রকম মানুষের সৃষ্ট সত্যগুলো কৌতূহলোদ্দীপক যদিও সেগুলোর পরিধি খুবই সংকীর্ণ। এ সত্যের পরিধি বিস্তৃত করবার বাড়াবাড়িতেই মানুষ প্রোপাগাণ্ডার তাণ্ডবলীলায় মেতে ওঠে, যুদ্ধ ও মহামারী এবং দুর্ভিক্ষের রূঢ়তম আঘাতে তার সমাপ্তি ঘটে। ইউরোপের সাম্প্রতিক ইতিহাস এরকমভাবে প্রয়োগবাদের অসারতারও নিরপেক্ষ দৃষ্টান্ত।
প্রয়োগবাদীরা বেগর্সকে কেননা মিত্র বলে অভিনন্দিত করেছিলেন তা আশ্চর্য ব্যাপার, যেহেতু তার দর্শন তাদের দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল প্রয়োগবাদীরা প্রয়োজনীয়তাকে সত্যের আসল সংজ্ঞা বলে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে বেগর্স শিক্ষা দিয়েছেন, আমাদের মেধা বাস্তব প্রয়োজনের উপযোগী হিসেবে গড়ে ওঠে এবং পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করে না, অগ্রাহ্য করে এবং প্রকৃতপ্রস্তাবে সত্যের ধারণা পোষণ করার প্রধান প্রতিবন্ধক। তিনি মনে করতেন, আমাদের এরকমের সজ্ঞা বা (Intuition) নামে একজাতীয় ইন্দ্রিয়বৃত্তি আছে; কষ্ট করলে পরে আমরা তা ব্যবহার করে যদিও আপাতঃদৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নয় থিয়োরিগতভাবে অতীত বর্তমানের প্রত্যেক জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারব। অনেক বেশি জ্ঞান নিয়ে অসুবিধায় পড়তে হয় বলে আমার মগজের উৎকর্ষ সাধন করেছি, ভুলে যাওয়াই হলো যার কাজ। কিন্তু মগজের কারণেই আমরা সবকিছু মনে করতে পারি এবং মগজ চালুনির মতো ঠেলে দেয় বলে আমরা শুধু প্রয়োজনীয় সবকিছু ও ভ্রান্তিসমূহকে মনে করতে পারি। বের্গসের মতে প্রয়োজনীয়তা হলো ভুলের উৎসবিশেষ। পরম্ভ মরমীর ধ্যান থেকে যে সত্যে পৌঁছনো যায় তাতে বাস্তব সুবিধার সকল চিন্তা অনুপস্থিত থাকে। তা সত্বেও বেগর্স প্রয়োগবাদীদের এত যুক্তির চেয়ে কর্মকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন, হ্যামলেটের চেয়েও যে লোককে তিনি ভালো মনে করতেন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কারণে রাজাকে বাঁচাতে দেয়ার চাইতে, স্বতস্ফূর্ত স্বজ্ঞায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভেসডিমোনাকে হত্যা করা অধিকতর শ্রেয় মনে করেনে। একারণেই প্রয়োগবাদীরা তাকে মিত্র বলে মনে করেছিলেন।
বের্গসঁর ডনিস ইমিডিয়েট দ্যালা ক’সাস ১৮৮৯ সালে, মেটেরিয়েল এট মেমোয়ার ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ সালে (L Evalution Creatrice) ল্যা ইভসন ক্রিটিজ প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিখ্যাত হয়ে পড়েন। তার এই বইটি অন্যান্য বইয়ের চেয়ে উৎকৃষ্ট ছিল না, কিন্তু তাতে উপাদানের তুলনায় ছন্দ হিল্লোল বেশি ছিল বলে অতি সহজে মানুষকে অভিভূত করেছিল। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোন যুক্তি ছিল না। সুতরাং কুযুক্তিও ছিল না। বইটিতে কল্পনাকে উজ্জীবিত করার এত ভাবাবেগপূর্ণ কবিত্বের একটি মনোরম বর্ণাঢ্য ছবি ছিল। যে দর্শনের পক্ষে ওকালতি করেছেন, তা সত্য কি মিথ্যা সে সম্পর্কে একটি বর্ণও উচ্চারণ করেন নি; কিন্তু প্রশ্ন বের্গসঁ অন্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন, তা কোনমতেই অপ্রয়োজনীয় নয়। তার আপন থিয়োরি মতে তিনি এক্ষেত্রে যথার্থ, কেননা সত্যকে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ দিয়েই জানা যায়, বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে নয়; সুতরাং যুক্তি-প্রমাণের কেনো প্রয়োজন পড়ে না।
বের্গসঁর দর্শনের বেশিরভাগই ঐতিহ্যিক দর্শনকে একটু উন্নত ধরনের ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। পরস্পরব্যাপ্ত মতবাদ অনুসারে (The doctrine of interpenetration) বিভিন্ন বস্তু পরস্পর প্রকৃত সম্পর্কশূন্য নয় বিশ্লেষাত্মক বুদ্ধিবৃত্তি অনুসারে সে গুলোকে খণ্ডিত হিসেবে চিন্তা করা হয়, পারমেনাইডস (Pamenides) থেকে ব্রাডলে (Bradley) পর্যন্ত প্রাচী প্রতিটির সকলের তাই ধারণা। বের্গ দু’উপায়ে এ মতবাদকে মহিমামণ্ডিত করেছেন। প্রথমতঃ তিনি বস্তুর সজ্ঞা বা স্বতস্ফূর্ত আবেগের সঙ্গে প্রবৃত্তির সংযোগ সাধন করেছেন। বোলতা ডিম পাড়ার পূর্বে শুক কীটকে হত্যা না করে হুল ফুটিয়ে অবশ করে ফেলে এবং তাই হলো বোলতার ইনট্যুইশন বা স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ। (যেহেতু ড. পেকহাম এবং মিসেস পেকহাম দেখিয়েছেন যে বেচারা বোলতা বিজ্ঞানের মানুষের চাইতে তার বুদ্ধিবৃত্তিকে ভুল পথে পরিচালনা করছে না, সুতরাং দৃষ্টান্তটি ধোপে টিকে না। এজন্য তার মতবাদে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রভাব পড়েছে এবং তাকে উদ্ভিদসম্বন্ধীয় উদাহরণ দিতে অনুপ্রাণিত করেছে, তার মতবাদ জীববিজ্ঞানসম্বন্ধীয় সর্বাধুনিক গবেষণার উপর প্রতিষ্ঠিত বলে তিনি অসতর্কভাবে চিন্তা করেছেন। দ্বিতীয়তঃ বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণে যেমন দেখা যায় তেমনি তিনি বস্তুর আলাদা আলাদা অস্তিত্বকে পাত্র বা বিস্তৃতি এবং কাল বা স্থায়ীত্বের ব্যাপ্ততাকে সজ্ঞা বা ইনটুইশান আখ্যায় আখ্যায়িত করেছেন। তা তাকে কাল ও পাত্র সম্পর্কে অনেক অভিনব তথ্য পেশ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। এ শব্দগুলোর মামুলি অর্থ চিন্তা করলে সেগুলোকে খুবই যুক্তিযুক্ত এবং মৌলিক বলে মনে হয়। পাত্র অথবা বিস্তৃতির মধ্যে স্থিত যা তাকেই পদার্থ বলা যায়। আমরা সজ্ঞা বা ইনটুইশানের দৃষ্টিকোণ থেকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাব, তা হলো বুদ্ধিবৃত্তির সৃষ্ট একটি উপকথা মাত্র।