জেমসের বিশ্বাস করার ইচ্ছা (Will to believe) ১৯৮৭ সালে প্রয়োগাদ (Pragmatisom) ১৯০৭ সালে শিলারের মানবতাবাদ (Humanism) এবং ডিউয়ির ন্যায়শাস্ত্র (Studies in logical theory) ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয়। বিংশশতাব্দীর প্রথম বছরসমূহে দর্শনজগত প্রয়োগবাদের গুণগানে মুখরিত ছিল। তার পরে বেগর্স কতিপয় পরীক্ষায় ফেলে তা অকেজো করে ফেললেন। প্রযোগবাদের তিনজন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে বিস্তৃত পার্থক্য রয়েছে, আমরা জেমস, শিলার এবং ডিউয়িকে যথাক্রমে ধর্মীয় সাহিত্যিক এবং বৈজ্ঞানিক অভিনেতা হিসেবে ধরে নিতে পারি। যদিও জেমস ছিলেন বহুমুখী, কিন্তু তার একমাত্র ধর্মীয় বোধেরই প্রয়োগবাদে উক্রান্তি ঘটেছে। চলুন আমরা এ সকল পার্থক্যের কথা ভুলে গিয়ে সম্পূর্ণমতবাদকে একীভূত সূত্র হিসেবে উপস্থিত করি।
এক রকমের সংশয়বাদ হলো এ মতবাদের ভিত্তিভূমি। ঐতিহ্যগত দর্শন ধর্মের ক্ষেত্রে মতবাদকে প্রমাণ করার অক্ষমতা প্রচার করল এবং বিরুদ্ধবাদীরা ধর্মকে অপ্রমাণ অথবা নিদেন পক্ষে স্পেনসারের মতো ধর্মবিশ্বাসকে প্রমাণ করা যায় না একথা প্রমাণ করার কথা ঘোষণা করল। সে যাহোক, ধর্মীয় মতবাদকে প্রমাণ অথবা অপ্রমাণ কিছুই করা যায় না। অনেক মতবাদের ক্ষেত্রে একই ফলশ্রুতি দেখা গেল; যাকে স্পেনসারের মতো মানুষেরা পরিবর্তনীয় মনে করলেন। সেগুলো হলো কার্যকারণ, সম্বন্ধ, আইনের সীমানা, স্মৃতির সাধারণ বিশ্বাস, অযোগ্যতা, অবরোহ পদ্ধতির যথার্থতা ইত্যাদি। প্রকৃত বিবেচনাসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে নিরীশ্বরবাদের উৎকণ্ঠিত রায়ের মধ্যে এ সকল উপাদানের বিলুপ্তি ঘটা উচিত! যতদূর পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই ততদূর এগুলো প্রমাণ অপ্রমাণ কিছুই করা যায় না। জেমস বলেন বস্তুজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ হিসেবে যদি আমরা বেচে থাকতে চাই, তাহলে এসব বিষয়ে আমাদের সন্দিহান থাকলে চলবে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা অবশ্যই কল্পনা করতে পারি, যে খাদ্য অতীতে আমাদের পুষ্টিবৃদ্ধি করেছে ভবিষ্যতে তা আমাদের শরীরে বিষক্রিয়া করবে না। অনেক সময় তা আমরা ভুলে যাই এবং মারা পড়ি। জীবনের উন্নতি এবং আকাক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর মধ্যেই বিশ্বাসের পরীক্ষার সাফল্য প্রমাণিত হয় এবং যে পর্যন্ত না আমরা বস্তুজগত সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা পোষণ করতে না পারি সে পর্যন্ত আমাদের বিশ্বাস বস্তুর সঙ্গে যাচাই করার সঙ্গতি রক্ষা করবে না। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জেমস বিভিন্ন ধর্মীয় অভিজ্ঞতা (The varieties religious experiance) বইতে দেখাতে চেয়েছেন, অনেক সময় ধর্মবিশ্বাস পরীক্ষার পরে টিকে থাকে, সুতরাং তাকে সত্য বলে গ্রহণ করা উচিত। তিনি শুধু এ অর্থে বলেছেন যে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য থিয়োরিকে বাস্তবে প্রয়োগ করা যায় যখন তখনই আমরা তা সত্য বলে গ্রহণ করি এবং সে সম্পর্কে বই-ই হলো আমাদের জানাশোনার মাধ্যম।
বিজ্ঞান এবং ধর্মের সাধারণ অনুমানের মধ্যে প্রয়োগ করা যায় বলেই এই মতবাদ সম্পর্কে বলার মতো অনেক কিছু রয়েছে। কর্মক্ষম বলতে কি বুঝায় সে সম্পর্কে একটি সাবধানী সংজ্ঞা নিরূপণ এবং যে যে ক্ষেত্রে আমরা সত্য সম্পর্কে ওয়াকেবহাল নই, তা পূর্বাহ্নে নির্ধারণ করতে পারলে ধর্মীয় মতবাদের সঙ্গে ঝগড়া বাধাবার কোন প্রয়োজন পড়ে না। যেখানে আসল সত্য উদঘাটন করা দূরূহ নয় সে সম্পর্কে চলুন আমরা মামুলি দৃষ্টান্তের অবতারণা করি। যেমন ধরুন আপনি এক ঝলক বিজুলী শিখা দেখতে পাওয়ার পর বজ্রপাতের শব্দ আশা করবেন অথবা বজ্রপাত অতি দূরে হওয়ার শব্দ আপনার কর্ণগোচর হলো না অথবা আপনি সে ব্যাপারে মোটেই চিন্তা করলেন না। সাধারণতঃ এই শেষেরটা অত্যন্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যাপার, ধরুন আপনি উপরের দুটোর যে কোন একটিকেই গ্রহণ করলেন। যখন আপনি বজ্রপাতের শব্দ শুনলেন, আপনার বিশ্বাস তখন সত্য প্রমাণিত হলো না। তা বিচার করবেন একটি বাস্তব ঘটনা-বজ্রপাতের শব্দ শোনার প্রতিক্রিয়া অনুসারে, কিন্তু উদ্ভুত সুবিধা অসুবিধা হিসেবে নয়। প্রয়োগবাদীদের কারবার প্রধানতঃ সে সকল বিশ্বাস নিয়ে যা আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে যে সকল ঘটনা ঘটে তার সাহায্যে যাচাই করা যায় না। আমাদের দৈনন্দিন বিশ্বাসের অনেকগুলো জাগতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমিত, যেমন অমুক অমুকের ঠিকানা হলো এই এই ইত্যাদি। আমাদের অভিজ্ঞতার সাহায্যে তা যাচাই করা যায় এবং এ সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগবাদীদের বিচারপদ্ধতি অপ্রয়োজনীয়। অনেক ক্ষেত্রে বজ্রপাতের উপরোক্ত দৃষ্টান্তের এত তা মোটেই প্রয়োগশীল নয়, যেহেতু সত্যবিশ্বাস মিথ্যাবিশ্বাসের চাইতে কোন বাস্তব সুযোগ দান করে না এবং তা কোনকিছু সম্পর্কে যেমন চিন্তা করা হয়, তেমনি সুবিধাজনকও নয়। দৈনন্দিন জীবনের থেকে উদাহরণ না নিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ উদাহরণ গ্রহণ করেন, এটা দার্শনিকদের একটি সাধারণ দোষ।
প্রয়োগবাদ চূড়ান্ত দার্শনিক সত্যের উদঘাটন করতে না পারলেও এর কতেক প্রয়োজনীয় গুণাবলী রয়েছে। প্রয়োগবাদই প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছে, যে সত্য আমরা আয়ত্ব করতে পারি তা প্রত্যেক মানবিক ধারণার মতো প্রমাদসাপেক্ষ এবং পরিবর্তনশীল। মানুষের জীবনের ঘটনাচক্রের বাইরে যা আছ তা সত্য নয়, সত্য হলো বিশ্বাসসমূহের গুণগত নির্যাস এবং বিশ্বাস হলো আত্নিক ঘটনাপুঞ্জ। অধিকন্তু ওদের সঙ্গে ঘটনার সম্বন্ধ ন্যায়শাস্ত্র যেভাবে কল্পনা করে তেমন সরল সহজ নয় এবং তা নির্দেশ করে দেয়া ন্যায়শাস্ত্রের প্রয়োগবাদের দ্বিতীয় গুণ। বিশ্বাসসমূহ অনেক সময় স্পষ্টতঃ জটিল, একটি বিশেষ ঘটনার দিকে সোজাসুজি না তাকিয়ে অনেকগুলো ঘটনার ধূসর জগতে নিয়ে যায় টেনে। সুতরাং বিশ্বাসসমূহ ন্যায়শাস্ত্রের পরিকল্পিত প্রস্তাবের মতো তীক্ষ্ণভাবে সত্য এবং মিথ্যার বিরোধিতা করে না সেগুলো হলো সত্য এবং মিথ্যার সুস্পষ্ট ছাপ বিশেষ। ওগুলো ধূসর কালো এবং বহুবর্ণের হতে পারে কিন্তু সাদা নয় কখনো। যে সকল মানুষ সত্যের সম্পর্কে শ্রদ্ধাসহকারে কথা বলে, ঘটনা সম্পর্কে তা মনে করলে তারা অধিকতর ভালো করত এবং জানতে পেতো মানুষের যে শ্রদ্ধেয় গুণগুলোর প্রতি তারা সম্মান পোষণ করে, মানুষের বিশ্বাসের মধ্যে তা পাওয়া যায় না। এর বাস্তব এবং থিয়োরিগত সুবিধা রয়েছে, যেহেতু মানুষ সত্য জানতে পেরেছে এ অজুহাতে পরস্পর পরস্পরের উপর অত্যাচার করে। মনঃসমীক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে তা এভাবে বলা যায় যে সকল মানুষ উচ্চতর আদর্শের কথা বলে তা শত্রুদের নির্যাতন করার একটা অজুহাতমাত্র। ভালো জিনিসের যেমন প্রচার লাগে না, তেমনি ভালো নৈতিকতার জন্য কোন বাজি রাখার প্রয়োজন পড়ে না।