ইংরেজি ভাষাভাষী জগতে জার্মান আদর্শবাদের নাগপাশ যার প্রভাবে ছিন্ন হয় তিনি হলেন উইলিয়াম জেমস। মনস্তত্ত্বে তার যে পরিচয় বিধৃত ছিল সে হিসেবে নয়, ছোট ছোট যে পুস্তকগুলো তার শেষ জীবনে এবং মৃত্যুর পরে ধারাবাহিকবাবে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো তাকে নতুন পরিচয়ে চিহ্নিত করেছে। মাইণ্ড (Mind) কাগজে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত একটা প্রবন্ধে তিনি তার প্রবৃত্তিগত পক্ষপাতিত্ববোধকে অপূর্ব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রবন্ধটি তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত গ্রন্থাবলী র্যাডিক্যাল এমপিরিসিজমে সংযোজিত হয়েছে।
যেহেতু আমরা প্রধানত সংশয়বাদী, সেজন্য আমাদের কিছু সংখ্যক বিশ্বাসের অভিপ্রায় পরস্পরের কাছে অকপটভাবে স্বীকার করতে পারি। আমার সম্পর্কে আমি যা অকপটভাবে স্বীকার করতে পারি মূলতঃ সেগুলো সৌন্দর্যতত্ব সম্বন্ধীয় ন্যায়শাস্ত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। ব্রহ্মাণ্ডের নিখুঁত ত্রুটিহীন সর্বব্যাপ্ততা আমাকে সম্পূর্ণরূপে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলে। সম্ভাবনাহীন প্রয়োজনীয়তা, সম্বন্ধহীন বিষয়পুঞ্জ আমাকে অনুভব করতে বাধ্য করে যে কোন সংরক্ষিত অধিকার ব্যতিরেকেই আমি এমন একটা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি, তা যেন ব্যক্তিগত শয়নকক্ষহীন সমুদ্রতীরে বিরাট একটি বোর্ডিং হাউজে বাস করার মতো; যেখানে আমি সে অঞ্চলের সমাজ থেকে আত্নগোপণ করে থাকতে পারব। অধিকন্তু আমি তীক্ষ্ণভাবে সজাগ যে ঐ বিষয়ে আচারনিষ্ঠ ইহুদী এবং প্রাচীন ঝগড়াটে পাপীদের কিছু করার আছে। আমার ব্যক্তিগত জ্ঞান থেকেই বলছি, সব হেগেলপন্থীরা দাম্ভিক নয়, কিন্তু আমি অনুভব করি হেগেলপন্থী হওয়ার মধ্যেই সকল দাম্ভিকের পরিণতি। একটি গল্প আছে, দু’জন যাজককে ভুলক্রমে একটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। একজন এসেই শুরু করে দিল আমিই ধ্বংস আমিই জীবন, তখন অন্যজন প্রবেশ করে চিৎকার করে বলল আমিই ধ্বংস আমিই জীবন। দর্শন আমাদের অনেককে সে বিবদমান দু’যাজকের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
দর্শন বলতে অত্যন্ত সুরক্ষিত, বেদনাদায়ক এবং নিখুঁতভাবে নির্দেশিত এমন কিছুকে বোঝায় যা বিশাল অচেতন মৃদু নিঃশেষিত সঙ্গতির অতলান্ত গভীরতা এবং অজানা আবর্তের হয়ে কথা কয়।
উইলিয়াম জেমস হেগেলিয় দর্শনের সঙ্গে সামুদ্রপারের বোর্ডিং হাউজের তুলনা করেছেন, তিনি সেখানে কখনো বাস করেছেন বাজি রেখেও কেউ কখনো স্বীকার করবে না। ১৮৮৪ সালে এই প্রবন্ধের তেমন কোন প্রভাব ছিল না, কারণ তখন হেগেলিয় দর্শনের প্রাধান্য পুরোমাত্রায় বিরাজমান ছিল এবং প্রবৃত্তি যে তাদের মতামতের উপর প্রতিক্রিয়া করে তা দার্শনিকদের জানা ছিল না। ১৯৮২ সালে (প্রবন্ধে পুনঃমুদ্রণকালে) পরিস্থিতি বিভিন্ন কারনে পরিবর্তিত আকার ধারণ করে,তার মধ্যে হেগেল শিষ্যদের ওপর উইলিয়াম জেমসের প্রভাবকে অন্যতম ধরা যেতে পারে। তার লেখা ছাড়া তাকে ভাসাভাসার চেয়ে বেশি জেনেছি এ দাবি আমি করতে পারিনে। আমার ধারণা তার চরিত্রের তিনরকম বৈশিষ্ট্য যে-কেউ আবিষ্কার করতে পারে। এ তিনরকম বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। মনস্তত্ব এবং চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যয়নের প্রভাব শেষবার কিন্তু দর্শনের স্ফুরণে প্রথম তার মধ্যে মুকুলিত হয়ে উঠেছিল। খাঁটি সাহিত্যিক দার্শনিক প্লেটো, এ্যারিস্টোটল এবং হেগেল থেকে অনুপ্রেরণা-লব্ধ দার্শনিকদের তুলনায় বৈজ্ঞানিক এবং বস্তুবাদের প্রতি সামান্য পক্ষপাতসম্পন্ন রূপে তার দর্শন আত্নপ্রকাশ করেছিল। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির আলোচনার এত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদে ছাড়া সর্বত্রই এ ধারণা প্রাধান্য বিস্ত রি করেছে। তার দর্শনের কাঠামোর দ্বিতীয় উপাদান হলো মরমী এবং ধর্মীয় পক্ষপাত তা তিনি তার ভ্রাতার মতো পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছিলেন। এই পক্ষপাতই তার বিশ্বাস করার ইচ্ছা অথবা উইল টু বিলিভকে এবং আত্মা সম্বন্ধে গবেষণা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তৃতীয়তঃ তিনি তার ভাইসহ নিউইংল্যাণ্ডের বিবেকের সমস্ত আন্তরিকতা সহযোগে স্বাভাবিক আড়ম্বরকে নস্যাৎ করে তার স্থলে ওয়াল্ট হুইটম্যানের গণতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন। ওপরে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটির মধ্যে রুচিবাগীশতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তিনি ব্যক্তিগত শয়ন কক্ষ ছাড়া সাগর পাড়ে বোর্ডিং হাউজের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন (হয়তো হুইটম্যান যা ভালোবাসতে পারতেন) আচারনিষ্ঠ ইহুদী বলে নয়, পাপী এ দাবীতেই তিনি গণতান্ত্রিক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিতভাবে একজন আচারনিষ্ঠ ইহুদী ছিলেন না এবং সম্ভবতঃ তিনিও অন্যান্য মানুষের এত কিছু পাপ করে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি স্বভাবসুলভ বিনয় প্রকাশ করতে অকৃতকার্য হয়েছেন।
বিভিন্ন রকমের গুণাবলীর মিশ্রণের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ মানুষদের বিশেষত্ব ফুটে ওঠে, যা অনেকসময় অসঙ্গত রূপও ধারণ করতে পারে, উইলিয়াম জেমসের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল, তার সমসাময়িকেরা যা মনে করত তার তুলনায় তার ছিল অনেকগুণ বেশি। ধর্মীয় আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বৈজ্ঞানিক অনুমানের মতো করে ব্যক্ত করার পদ্ধতি হিসেবে তিনি প্রয়োগবাদের স্বপক্ষে ওকালতি করেছিলেন। মন এবং পদার্থের বিরোধ দু’টোর কোনটাকেই না খর্ব করে, নিস্পত্তি করার পদ্ধতি হিসেবে চেতনা বলে কোনকিছু নেই এ বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তন করেন। তার দর্শনের দু’পর্যায়ে বহু সহমর্মী তার ছিল। শিলার এবং বেগর্স ছিলেন প্রথম পর্যায়ের মিতা এবং নিওরিয়ালিস্ট, যা নব্য বস্তুবাদীরা ছিলেন পরবর্তী পর্যায়ে। প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র ডিউয়ি উভয়পর্যায়ে তার সঙ্গে ছিলেন। প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে স্বীকৃত রয়েছে, সে জন্য অবশ্যই আলাদা আলাদাভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।