বিংশ শতাব্দীতে দর্শন আনুষ্ঠানিকভাবে তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়ে গেছে। প্রথম শাখা জার্মান ধ্রুপদ দর্শনের অনুসারীদের নিয়ে গঠিত। দ্বিতীয় দলটা বের্গসঁ এবং প্রয়োগবাদীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে। তৃতীয় দলে যারা আছেন, তারা দর্শনে বিশেষ সত্য লুকিয়ে আছে এবং সে সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য বিশেষ পদ্ধতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন না করে সরাসরি বিজ্ঞানের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করেন। চিহ্নিত করবার জন্য তাদেরকে বস্তুবাদী আখ্যা দেয়া যেতে পারে; তার পরেও তাদের অনেককে সে পরিচয়ে পরিচিত করা যায় না।
বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যে পার্থক্য তা খুব তীক্ষ্ণ নয়। অংশতঃ এ গোষ্ঠী এবং অংশতঃ ও গোষ্ঠী বলে পরিচিত হয়ে থাকেন দার্শনিকেরা। উইলিয়াম জেমসকে প্রয়োগবাদ এবং বস্তুবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে। ডক্টর হোয়াইটহেড তার সাম্প্রতিক গ্রন্থে কমবেশি বের্গসিয় দর্শনের স্বপক্ষে ওকালতি করেছেন। অনেক দার্শনিক আছেন যারা উপযুক্ত যুক্তি না দেখিয়ে আইনষ্টাইনের বৈজ্ঞানিক মতবাদকে কার্যের স্থান কাল পাত্রের ভিত্তিভূমি বলে ধারণা করে থাকেন। যুক্তির পার্থক্যের চেয়ে বাস্তবের পার্থক্য অধিকতর সুস্পষ্ট। তা সত্বেও মতামতের শ্রেণীবিন্যাসের প্রয়োজনে যুক্তির বিভিন্নতার প্রয়োজন রয়েছে।
জার্মান আদর্শবাদ বিংশ শতাব্দীব্যাপী প্রতিরক্ষা ভূমিকা পালন করে আসছে। অধ্যাপক ছাড়া আর যারা নতুন গ্রন্থের বিচার করেন, তারাই নতুন নতুন গোষ্ঠীকে তুলে ধরেছেন। সমালোচনাকে সম্বল করে গ্রন্থের বিচার করেন বলে তারা ভাবেন যে এ সমস্ত গোষ্ঠী এখন অত্যাধিক প্রতিপত্তিশালী; কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে জার্মানি, গ্রেটবৃটেন, ফ্রান্স (আমেরিকা নাও হতে পারে) এখন দর্শনের ক্লাসিক ঐতিহ্যকেই আঁকড়ে ধরে রয়েছে। একজন যুবক তার সমালোচনা না করে সমর্থন করলে হোমরা চোমরা কেউকেটা একটা হয়ে যেতে পারে।
বিরুদ্ধবাদীরা এর মধ্যে অনেক জার্মান দোষ বের করবার চেষ্টা করেছেন; কিছু অংশে তা জার্মানির বেলজিয়াম আক্রমনের জন্য দায়ীও বটে। এই দলের সমর্থকেরা। বিখ্যাত এবং সম্মানিত ছিলেন তাই তাদেরকে আক্রমণ করে ঘায়েল করা খুব সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। ইমাইল বেজোস্ক এবং বানাল্ড বেসানকোয়েট মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে ফরাসি এবং বৃটিশ দর্শনের মুখপাত্র ছিলেন। এই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মোহগ্রস্থ এবং রক্ষনশীল দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মের স্বপক্ষে এবং বিপ্লবের প্রতিকূলে সদাসর্বদা আত্মপক্ষ সমর্থনে তৎপর ছিল। এ গোষ্ঠীর মধ্যে যারা পূর্বাবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইতেন, তাদের দুর্বলতা এবং ঐতিহ্যের শক্তি দুই-ই ছিল। কিন্তু নতুন চিন্তাধারার সজীবতা তাদের ছিল না। বিশংশতাব্দীর ঠিক পুর্বমুহূর্তে ইংরেজি ভাষাভাষি অঞ্চলসমূহে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে যখন মি. ব্রাডলের এপিয়ারেন্স আ্যন্ড রিয়ালিটি (Appearence and reality) গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তখন থেকে আমি দর্শন পাঠে গভীরভাবে মনোনিবেশ করি। ইংল্যাণ্ডে জার্মান। দর্শনের প্রকৃত স্বীকৃতি আদায় করার ব্যাপারে যাদের সংগ্রাম করতে হয়েছিল মি. ব্রাডলে তাদের একজন। ঐতিহ্যগত গোঁড়ামির সমর্থকদের তুলনায় তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উর্ধ্বে। অন্যান্য সমসাময়িকের মতো তার এ্যাপিয়ারেন্স অ্যাণ্ড রিয়ালিটি আমার মধ্যে গভীরভাবে আবেদন সৃষ্টি করেছিল, যদিও সেসব গ্রন্থের মতামতের সঙ্গে আমি ভিন্ন ধারণা পোষণ করি, তবু সেগুলোকে আমি এখনো খুবই সম্মানের চোখে দেখে থাকি।
হেগেলপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গীর বৈশিষ্ট্য হলো একমাত্র ন্যায়শাস্ত্রই আমাদেরকে বাস্তব পৃথিবীর সব কিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে তুলতে পারে। মি. ব্রাডলেও অংশতঃ তাই বিশ্বাস করতেন। তার মতামত হলো যেহেতু পৃথিবীটা বাইরের দিক থেকে দেখতে গেলে স্ববিরোধী এবং সে জন্য মায়াময়, সুতরাং ন্যায়শাস্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে আশ্চর্যজনক কোন বৈশিষ্ট্য এর থাকতে পারে না। তার মধ্যে পরস্পর-সংশ্লিষ্ট বিচিত্র কিছু থাকতে পারে না এবং তার পৃথক পৃথক সত্তা এমনকি জানার জন্য কর্তা কর্মের মধ্যেও কোন বিভিন্নতা থাকতে পারে না সুতরাং একটি শর্তহীন সত্তার মধ্যেই সামাজিক বৈশিষ্ট্যটি নিরবধিকাল থেকে বিরাজমান এবং আকাক্ষা ও চিন্তাকে বাদ দিয়ে অনুভূতিরই সমগোত্রীয়।
ঘটনাগুলো ঘটনা নয়, আদতে আমাদের ভূপৃষ্ঠের যা কিছু ঘটে সব মায়া। এই মতবাদের ফলে নৈতিকতার ধ্বংসসাধন হওয়া উচিত; কিন্তু নৈতিকতা হলো প্রবৃত্তিগত এবং ন্যায়শাস্ত্রের আওতার বাইরে। হেগেলপন্থীরা যে আবেদন করে থাকেন প্রকৃত প্রস্তাবে তার মূলনীতি হলো যেহেতু হেগেলিয় দর্শন সত্য, সুতরাং আমাদের সে অনুসারে কাজ করা উচিৎ। কিন্তু তাদের জানা উচিত যে এ দর্শন সত্য হলে আমরা যেভাবে গ্রহণ করেছি সেভাবে না করে ভিন্নভাবে গ্রহণ করতাম।
এই দর্শনকে দু’দিক থেকে আক্রমণ করা হয়েছে। একদিকে আছেন নৈয়ায়িকেরা, যারা হেগেলের মধ্যে ভ্রান্তিকে সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন; তাছাড়াও সংযোগ, বহুত্ব, স্থান-কাল ইত্যাদি অনেক স্ববিরোধী তথ্যের অসারতা প্রমাণ করেছেন। অন্যদিকে ছিলেন তারা যারা চিন্তাকে ন্যায়শাস্ত্রের সৃষ্ট মতে সীমিত এবং অনুগত রাখতে অস্বীকার করলেন। তাদের মধ্যে উইলিয়াম জেমস এবং বেগ ছিলেন প্রধান। এই দু’মুখো আক্রমণের দু’একটি বিস্ফোরণকে বাদ দিলে দর্শন ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে সঙ্গতিবিহীন ছিল না। ভিন্নরকমের জ্ঞানের প্রভাবে অনুপ্রাণিত বলে দু’য়ের মধ্যে প্রকৃতিগত প্রভেদ ছিল বিস্তর। দু’দলের আবেদনও দু’রকম। একদলের আবেদন ছিল আনুষ্ঠানিক এবং অন্য দলের মানবিক। আনুষ্ঠানিক আবেদন হেগেলিয় যুক্তি দেখিয়ে হেগেলিয় দর্শনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল; স্বভাবতঃই মানবীয় আবেদন অধিকতর সফলতা অর্জন করে।